“ছায়ার নাম, রাতের রক্ত”
রাত গভীর।
কিন্তু সেই অন্ধকারে আজ নতুন কিছু আছে—
একটা অস্বস্তিকর ভারী নীরবতা,
যেন পুরো পৃথিবী নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে।
ইরা আর মায়া দু’জনে বসে আছে টেবিলের আলোয়।
দুজনে কোনো কথা বলছে না—
তারা দু’জনেই জানে,
বাইরে যেই ছায়া দাঁড়িয়েছিল,
সে আবার ফিরে আসবে।
মায়া মোমবাতি জ্বালাল।
হাওয়ায় আলোটা দুলল—
আর তার মুখের ছায়াগুলো আরো তীক্ষ্ণ, আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।
ইরা তাকিয়ে রইল।
— “তুমি জানো ও কে?”
মায়া গভীর নিঃশ্বাস নিল।
— “না… কিন্তু আমি ওর গন্ধ চিনি।”
ইরা কেঁপে উঠল।
— “গন্ধ?”
মায়া মাথা নেড়ে বলল—
— “হ্যাঁ।
একটা বিশেষ গন্ধ থাকে…
যে মানুষ আমাকে শিকার করেছিল…
তার মতোই।”
ইরার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
— “মানে… এই ছায়া-মানুষটা তোমার অতীতের সেই লোক?”
মায়া মাথা নেড়ে না বলল।
কিন্তু তার চোখে অজানা ভয়।
— “না। ও সেই লোক না।
কিন্তু ওর আরেকটা পরিচয় আছে…
যেটা আমি বলিনি।”
ইরা চুপ করে রইল।
মায়া ফিসফিস করল—
— “ও… আমার মতোই।”
ইরা প্রশ্ন করল—
— “মানে?”
মায়া ধীরে বলল—
— “ও মানুষ না।”
ইরার বুক ধ্বক করে উঠল।
— “তাহলে…?”
মায়া বলল—
— “ও আমার মতোই অর্ধ-ছায়া।
অর্ধ-মানুষ।
কিন্তু আমার অন্ধকারের পাশে
ওর অন্ধকার অনেক বেশি পুরোনো।”
ইরা সামনের দিকে ঝুঁকে বলল—
— “মায়া… তুমি কি আমাকে এখন বলবে
কি ভাবে তোমার এই রাতের রূপ তৈরি হলো?”
মায়া কিছুক্ষণ দাঁত চেপে রাখল।
তারপর গলা ভারী হয়ে বলল—
— “আজ বলব।
কারণ তুই এখন বিপদে।”
---
◆ ১. মায়ার সত্যির দ্বিতীয় দরজা
মায়া চায়ের কাপটা হাতে ধরে বসে।
হাতের কাপ কাঁপছে।
— “মাত্র ১৪ বছর বয়স…
যেদিন আমাকে ধরেছিল…
সেদিন আমি বাঁচতে বাঁচতে একটা জিনিস করেছিলাম।”
ইরা শ্বাস আটকে শুনছে।
— “আমি ওকে আঘাত করেছিলাম।”
ইরার চোখ বড় হয়ে গেল।
— “কিভাবে?”
মায়ার গলার স্বর আর্দ্র হয়ে গেছে।
— “আমি ভয় আর রাগে…
ওর চোখে একটা কাঁচের টুকরো ঢুকিয়ে দিই।”
ইরা মুখে হাত চাপল।
মায়া বলল—
— “ও তখনই মারা যায়নি…
কিন্তু ওর চোখ থেকে যে রক্ত বের হচ্ছিল
সেই রক্ত আমার হাত, মুখ, গলায় লেগেছিল।”
ইরা ধীরে জিজ্ঞেস করল—
— “তারপর…?”
মায়ার কণ্ঠ ভেঙে গেল—
— “সেই রক্তের গন্ধ…
সেই মানুষের মৃত্যু-চিৎকার…
আমার ভেতর কিছু খুলে দেয়।
একটা অন্ধকার দরজা।
যেটা কোনোদিন বন্ধ হয়নি।”
ইরা হাত বাড়িয়ে মায়ার হাত ধরল।
মায়া চোখ নিচু করে বলল—
— “সেই রাতেই প্রথম
আমার শরীর রাত নামলে বদলাতে শুরু করেছিল।
অন্ধকারকে দেখতে পেতাম।
ছায়ারা আমাকে চিনত।
আমি ওদের ভাষা জানতাম।”
ইরা বলল—
— “মানে… তুমি ওই সময়েই… অর্ধ-ছায়া হয়ে গেলে?”
মায়া মাথা নেড়ে বলল—
— “হ্যাঁ।”
তার পরের কথা আরো ভয়ঙ্কর—
— “আর সেই ছায়া-মানুষটা…
যে আজ দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিল…
ও প্রথম দিন থেকে আমাকে দেখছে।
আমি বদলানোর পর থেকেই।”
ইরা কেঁপে উঠল।
— “মানে… ওই ছায়া-মানুষটা তোমাকে অনুসরণ করছে বছরের পর বছর?”
মায়া বলল—
— “হ্যাঁ।
আর আজ…
ও তোকে দেখে গেছে।”
---
◆ ২. ছায়ার দাবি – ইরাকে কেন্দ্র করে
ইরা মাথা নিচু করল।
তার ভিতর কাঁপছে—
ভয়, ভালোবাসা, অদ্ভুত টান সব একসঙ্গে।
— “ও আমাকে কেন চাইবে?”
মায়া ইরার দিকে তাকাল—
গভীর, নরম, কিন্তু ভয়ঙ্কর দৃষ্টি।
— “কারণ তুই আলো।”
ইরা অবাক—
— “আমি আলো?”
মায়া ফিসফিস করল—
— “হ্যাঁ…
ছায়ারা আলো দেখে মুগ্ধ হয়…
কিন্তু তারা আলোকে দখল করতেও চায়।
কারণ আলো ছাড়া ছায়ার অস্তিত্ব থাকে না।”
ইরার বুক ধড়ফড় করছে।
— “তাহলে… ও আমাকে নিয়ে কি করতে চায়?”
মায়ার চোখে রক্তিম রাগ জ্বলে উঠল।
— “তাকে নিজের করে নিতে।
যেভাবে রাতের আমি তোকে চাই।”
ইরা কেঁপে বলল—
— “রাতের তুমি কি আমাকে… সেইভাবে চাও?”
মায়া এগিয়ে এসে ইরার কানের কাছে ফিসফিস করল—
— “তার থেকেও বেশি।”
ইরার শরীর শিহরিত হলো।
এটা ভয়,
আকর্ষণ,
অধিকার—
সব মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি।
মায়া বলল—
— “কিন্তু আমি তোকে আদর করি।
আর ও তোকে গ্রাস করবে।”
ইরা গলার স্বর কমিয়ে বলল—
— “তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে?”
মায়া ধীরে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—
— “প্রয়োজনে আমার জীবন দিয়ে।”
ইরার চোখ ভিজে উঠল।
সে মায়ার বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করল—
— “আমি তোমাকে হারাতে চাই না।”
মায়া ধীরে ইরাকে বুকের ভেতর টেনে নিল।
— “তুই হারাবি না।
কিন্তু লড়াই শুরু হয়েছে।”
---
◆ ৩. ছায়ার আগমন – পরিচয় প্রকাশ
ওই সময়—
হঠাৎ জানলার বাইরে
একটা নরম, ঠান্ডা শ্বাসের শব্দ।
শশ্শ্…
মায়া থমকে গেল।
ইরা কাঁপতে কাঁপতে বলল—
— “এটা কি?!”
মায়া গর্জে উঠল—
— “ও।”
দু’জনে জানলার দিকে তাকালো।
কাঁচে একটুও আলো নেই—
শুধু একটা আকৃতি দাঁড়িয়ে আছে।
উঁচু, চিকন, ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তি।
হঠাৎ সেই ছায়া
কাঁচের ওপারে মুখ কাছে এনে
নরম স্বরে বলল—
— “ইরা…”
ইরা ছিটকে মায়ার পেছনে লুকাল।
— “এটা আমার নাম জানে!”
মায়া দাঁত চেপে বলল—
— “কারণ আজ থেকে তুই ওর লক্ষ্য।”
ছায়া-মানুষটা ধীরে বলল—
— “মায়া…
অনেক বছর পর দেখা হলো…”
মায়ার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
ইরা বিস্ময়ে বলল—
— “তুমি… তোমাকে চেনে?!”
ছায়া-মানুষটা হাসল—
একটা ঠান্ডা, অমানুষিক হাসি।
— “চিনি।
কারণ মায়া যেমন ‘অর্ধ-ছায়া’…
আমি তেমন ‘পূর্ণ ছায়া’।
আমি তাকে তৈরি হতে দেখেছি।”
ইরা শ্বাস নিতে ভুলে গেল।
মায়া গর্জে উঠল—
— “তুই কেন এখানে?!”
ছায়া-মানুষটা বলল—
— “ইরাকে নিতে।
ও আমার আলো।”
ইরা ভয়ে পিছিয়ে গেল।
মায়া চোখ পুরো লাল হয়ে ধীরে বলল—
— “তোকে স্পর্শও করতে পারবি না।”
ছায়া হাসল—
— “তোমার রাতের রূপ…
ইরা-কে যতটা চায়
আমি তার চেয়েও বেশি চাই।”
মায়ার শরীর থরথর করে উঠল।
— “ইরা আমার।”
ছায়া ধীরে বলল—
— “হ্যাঁ।
সেটাই সমস্যা।”
হঠাৎ—
জানলার কাঁচে দু’টো নখের দাগ কাটা গেল।
ছররররর—
ইরা চিৎকার করল।
মায়া তাকে জড়িয়ে ধরল।
ছায়া-মানুষটা বলল—
— “মায়া…
তোমার মতো আরেকজন অর্ধ-ছায়া
আমি কখনো দেখি নি।
আর ইরা—
সে আলো।
আমরা দু’জনেই তাকে চাই।”
মায়া ফিসফিস করে বলল—
— “ওকে চাইলে আমি তোর শত্রু।”
ছায়া বলল—
— “ঠিক তাই…
এখন যুদ্ধ শুরু হোক।”
তারপর—
এক ঝটকায় ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
জানলাটায় আবার ভয়ঙ্কর নখের দাগ রয়ে গেল।
---
◆ ৪. যুদ্ধ ঘোষণা
ইরা কাঁপছে।
— “মায়া… আমি কি তোমার জন্য সমস্যা হয়ে গেছি?”
মায়া তার মুখ ধরে বলল—
— “তুই আমার সমস্যা না…
তুই আমার সবকিছু।”
ইরার চোখে জল।
মায়া বলল—
— “ও আবার আসবে…
আরো শক্তি নিয়ে।”
ইরা ফিসফিস করল—
— “তুমি কি ওকে হারাতে পারবে?”
মায়া ঠান্ডা চোখে বলল—
— “পারব।
যদি তুই আমার পাশে থাকিস।”
ইরা কাছে সরে এসে
তার কপালে মায়ার কপাল ঠেকাল।
— “আমি আছি।”
মায়া চোখ বন্ধ করল।
— “এখন থেকে…
দিনে আমি তোকে ভালোবাসব…
রাতে আমি তোকে রক্ষা করব।”
ইরা মায়ার গাল ছুঁয়ে বলল—
— “আর আমি তোমাকে ভাঙতে দেব না।”
মায়া ধীরে হাসল—
— “তুইই আমার আলো, ইরা।
আর আলোকে রক্ষা করা—
আমার জন্মগত অধিকার।”
সেদিন রাত—
দুজনে প্রথমবার
আলো আর ছায়ার মতো
এক হয়ে গেল।
কিন্তু ছায়া-মানুষটা?
সে ফিরে আসবে।
আরও শক্তিশালী হয়ে।
আরও ভয়ঙ্কর হয়ে।
আরও দাবি নিয়ে।
কারণ ইরা শুধুই মানুষ না—
সে ছায়াদের লক্ষ্য হয়ে গেছে।
এখন গল্প মাত্র শুরু।
---
চলবে ____