Story of Mahabharat Part 155 Regret of Yudhisthir and keeping promise by Arjun in Bengali Spiritual Stories by Ashoke Ghosh books and stories PDF | মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 155

Featured Books
Categories
Share

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 155

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৫৫

অর্জুনের পণ রক্ষা এবং যুধিষ্ঠিরের অনুতাপ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

অর্জুনের পণ রক্ষা এবং যুধিষ্ঠিরের অনুতাপ

কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমাকে কটুবাক্য বলো না, তুমি রণভূমি থেকে এক ক্রোশ দূরে রয়েছ। ভীম আমার নিন্দা করতে পারেন, কারণ তিনি শ্রেষ্ঠ বীরগণের সঙ্গে সিংহবিক্রমে যুদ্ধ করছেন। পণ্ডিতগণ বলেন, ব্রাহ্মণের শক্তি বাক্যে আর ক্ষত্রিয়ের শক্তি বাহুতে। কিন্তু ক্ষত্রিয় হলেও তোমার বল বাক্যে এবং তুমি নিষ্ঠুর। আমি কেমন তা তুমি জানো। স্ত্রী পুত্র ও জীবন দিয়েও আমি সর্বদা তোমার কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করি, তা সত্বেও তুমি যখন আমাকে বাক্যবাণে আঘাত করছ তখন বুঝেছি তোমার কাছে আমাদের কোনও সুখলাভের আশা নেই। তুমি দ্রৌপদীর শয্যায় শুয়ে আমাকে অবজ্ঞা কোরো না। তোমার জন্যই আমি মহারথগণকে বধ করেছি, তাতেই তুমি নির্ভয় ও নিষ্ঠুর হয়েছ। অধিরাজের পদ পেয়ে তুমি যা করেছ তার আমি প্রশংসা করতে পারি না। তোমার পাশা খেলায় আসক্তির জন্য আমাদের রাজ্যনাশ হয়েছে, আমরা বিপদে পড়েছি। তুমি মন্দভাগ্য, এখন কটু বাক্যের আঘাতে আমাকে ক্রুদ্ধ কোরো না।

যুধিষ্ঠিরকে এইসব কটুকথা বলে অর্জুন অনুতপ্ত হয়ে হাতে তরবারি নিলেন। কৃষ্ণ বললেন, একি, তুমি আবার তরবারি নিয়েছ কেন? অর্জুন বললেন, যে শরীরে আমি অন্যায় আচরণ করেছি সে শরীর আমি নষ্ট করবো। কৃষ্ণ বললেন, যুধিষ্ঠিরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেছ সেজন্য তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ? যদি তুমি সত্যরক্ষার জন্য জ্যেষ্ঠ ভাইকে বধ করতে তবে তোমার কি অবস্থা হতো? অজ্ঞ লোকের কাছে ধর্মের তত্ত্ব সূক্ষ্ম ও দুর্জ্ঞেয়। আমি যা বলছি শোনো। আত্মহত্যা করলে তোমার ভাইকে হত্যার চেয়ে গুরুতর পাপ হবে। এখন তুমি নিজের মুখে নিজের গুণকীর্তন করো, তাতেই আত্মহত্যা হবে।

তখন অর্জুন তার তরবারি রেখে দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলতে লাগলেন, মহাদেব ভিন্ন আমার তুল্য ধনুর্ধর কেউ নেই। আমি মহাদেবের অনুমতিতে মূহুর্তের মধ্যে চরাচর সহ সমস্ত জগৎ বিনষ্ট করতে পারি। রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে আমিই সকল দিক ও দিকপালগণকে জয় কোরে আপনার বশে এনেছিলাম। আমার তেজেই আপনার দিব্য সভা নির্মিত এবং রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হয়েছিল। আমার ডান হাতে বাণ, বাম হাতে বিশাল ধনু এবং দুই পায়ের নীচে রথ ও পতাকা আঁকা আছে, আমার তুল্য পুরুষ যুদ্ধে অজেয়। সংশপ্তকদের অল্পই অবশিষ্ট আছে, শত্রুসৈন্যের অর্ধেক আমি ইতিমধ্যে বিনষ্ট করেছি। আমি অস্ত্র দ্বারাই অস্ত্রজ্ঞদের বধ করি। কৃষ্ণ, শীঘ্র চলো, আমরা বিজয়রথে চড়ে কর্ণকে বধ করতে যাই। আজ কর্ণের মা অথবা কুন্তী পুত্রহীনা হবেন, আমি সত্য বলছি কর্ণকে বধ না করে আমার কবচ খুলব না।

এই কথা বলে অর্জুন তার তরবারি এবং ধনু ত্যাগ করলে লজ্জায় নতমস্তকে হাত জোড় কোরে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, প্রসন্ন হন, যা বলেছি তা ক্ষমা করুন, পরে আপনি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন। আমি ভীমকে যুদ্ধ থেকে মুক্ত করতে এবং কর্ণকে বধ করতে যাচ্ছি। সত্য বলছি, আপনার কল্যাণ সাধনের জন্যই আমার জীবন। এই বলে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম কোরে যুদ্ধযাত্রার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।

যুধিষ্ঠির শয্যা থেকে উঠে দুঃখিত মনে অর্জুনকে বললেন, আমি অন্যায় করেছি, তার জন্যই তোমরা বিপদগ্রস্ত হয়েছ। আমি কুলনাশক পুরুষাধম, তুমি আমায় হত্যা করো। আমার মতো পাপী মূর্খ অলস ভীরু নিষ্ঠুর পুরুষের কথা শুনে তোমাদের কি লাভ হবে? আমি আজই বনে যাবো, মহাত্মা ভীমই তোমাদের যোগ্য রাজা, আমার ন্যায় ক্লীবের রাজা হওয়া ঠিক নয়? তোমার কটু কথা আমি সইতে পারছি না, অপমানিত হয়ে আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই।

অর্জুনের প্রতিজ্ঞারক্ষার বিষয় যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ বললেন, আমি আর অর্জুন আপনার শরণাগত, আমি প্রণত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আজ রণভূমি পাপী কর্ণের রক্ত পান করবে। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সসম্ভ্রমে কৃষ্ণকে উঠিয়ে হাত জোড় কোরে বললেন, আমরা নিজেদের দোষে বিপদে পড়েছিলাম, সেখান থেকে তুমি আমাদের উদ্ধার করেছ।

অর্জুন কাঁদতে কাঁদতে যুধিষ্ঠিরের পা জড়িয়ে ধরলেন। ভাইকে সস্নেহে উঠিয়ে আলিঙ্গন করে যুধিষ্ঠিরও কাঁদতে লাগলেন। তার পর অর্জুন বললেন, মহারাজ, আপনার পা স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করছি, আজ কর্ণকে বধ না কোরে আমি যুদ্ধ থেকে ফিরব না। যুধিষ্ঠির প্রসন্ন হয়ে বললেন, অর্জুন, তুমি যশস্বী হও, অক্ষয় জীবন ও অভীষ্ট লাভ করো, সর্বদা জয়ী হও।

______________

(ক্রমশ)