Saisab Churi books and stories free download online pdf in Bengali

Saisab Churi( শৈশব চুরি)

শৈশব চুরি

সমীর সিন্ হা

'আজ ছুটির' দিন তাই একটু বেশ মৌজ করে বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়ার পালা, তাই ঠিক করলাম 'চা' একটু পরেই খাবো। ভোরের ঘুম সবচেয়ে একান্ত আপন হয় তাই এক পশলা ঘুমের দেশে অবাধ বিচরণ এর চেষ্টা....

হঠাৎ কলিং বেলের ঘন্টা বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠল!

- কী রে চলে এলি ? শরীর খারাপ নাকি ?

- নাঃ ! আজ ক্যারাটে ট্রেনিং হবে না ।

- কেন ? হবে না কেন ?

- আজ ছুটি । গনতন্ত্র দিবস তো, তাই । নোটিশ টাঙ্গিয়ে দিয়েছে গেটে ।

- ও ! তা একটু খেলে আসতে পারতিস তো ! মাঠে কেউ নেই ? দেখলি ?

- দেখলাম । মাঠে কাদা । কেউ আসেনি । কয়েক দিন আগে হঠাৎ আসা প্রাকৃতিক বিপর্যয় সবাইকে চমকে দিয়ে গেছে ।

মা ছেলের কথোপকথন শুনছিলাম । মনে পড়ে গেল, কাদা মাঠে আমাদের সেই বল পেটানোর কথা.....

প্রথম শেখা ফুটবল খেলা কাগজে তৈরি বল কিংবা রান্না ঘরে পাওয়া যেকোন গোলাকার বস্তু, প্র্যাকটিস চলত মন লাগিয়ে,

আর, এই ভরা বর্ষায়, যখন বাড়ির বাইরে পা বাড়ানো ছিল দায়, দিন দশেকের টানা বৃষ্টিতে যখন সাধারণের জীবন অষ্ঠাগত তখন আমাদের চলত ল্যাং-মারামারির ফুটবল প্রতিযোগিতা আর জীবনের অন্যতম সেরা কিছু সময়ের আনন্দময় মুহুর্ত যা এখন এই বয়সে এসে উপলব্ধি করি।

মনে পড়ে গেল, ঔ সময় 'মহালয়ার' পুন্য তিথিতে ওয়ান ডে ফুটবল টুর্ণামেন্ট ছিল মাস্ট।

ভোরে 'বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রর' ঘুম ভরা চোখে ' মহালয়' বন্দনা শুনে সকালে টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়া তখন পাড়ায় পাড়ায় সারাদিন মাইক বাজিয়ে চলত ‘ওয়ান-ডে’ টুর্ণামেন্ট, কোথাও কোথাও বা ‘ডে-অ্যান্ড-নাইট’ । টিফিনে থাকত পাউরুটি কলা ডিম সেদ্ধ । দিনের শেষে ছোট্ট পিতলের কাপ বা মেডেল গলায় ঝুলিয়ে সেকি আনন্দ যেন দেশের হয়ে অলিম্পিকে সোনা জেতা, থ্রি চিআরসস্ ফর 'হ্যাংলা সংঘ' - 'হিপ হিপ' :হুর রে!

- ছেলেবেলায় সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে যেত আর যদি না ও বা ভাঙতো পাড়ার সাথিরা জগিংর বাহানায় ঘুম ভাঙিগে যেত আর আমার বাড়িতে দাদা থাকার জন্য জগিংর প্রস্তুতি টা হয়েই যেত আর সকাল সকাল মাঠে না পৌঁছলে আর খেলা পাওয়া যাবে না কারণ তখন অন্য পাড়ার বাচ্চারা এসে ভিড় করতো তাই কোন মতে মুখ-হাত ধুয়ে দাদা সঙ্গে দৌড় লাগাতাম,

সঙ্গে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়া জলের খুব প্রিয় বোতলটা সঙ্গ ছাড়াতো না ঘন্টা কয়েক অবধি বল পিটিয়ে, বাড়ি ফিরে কাদা-টাদা ধুয়ে, আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ছোলা আর বাড়ির বাগানের থানকুনি পাতা চিবতে চিবতে পড়তে বসতে না বসতেই ইস্কুলে যাওয়া সময় হয়ে যেত.....

(2)

- ইস্কুলের সেই মর্মান্তিক সময় সীমা অতিবাহিত করে বাড়িতে পা দিতে না দিতেই এবার ডাক, গুলি বা ডাংগুলি খেলার কখনও বা লাট্টু কিংবা শুধুই চাক্কা চালানোর ।

সাইকেলের পুরনো টায়ার একটা ছোট লাঠির টুকরো দিয়ে পেটানো 'রেস' কখনও কখনও বা কিছু না পেলে 'লুকোচুরি কিংবা' 'বউ-বাসন্তি' বেশীরভাগ সময়ই হতো আমাদের বানানো 'ক্রিকেট' যেখানে 'ঘোষ' কাকুর বাগানে বল গেলে 'ডিক্লিয়ার চার রান বাকি এইভাবে থাকতো রানের হিসেব এর ফাঁকে কারুর না কারুর বাবা, ঠিক হাজির হয়ে যেতেন অকুস্থলে । ব্যাস, খেলা ভঙ্গ । পিঠে দু’ঘা খেয়ে, দৌড়তে দৌড়তে পাখির ঝাঁকের সাথে বাড়ি ফেলার পালা... মনে পড়ে গেল বাড়ির সামনে নয়নজুলির উপর ভেসে যাওয়া 'ডাক' পাখির পরিবারের ছবি ।

বাড়ি ফিরে চান করে, কিছু খেয়ে, পড়তে বসতে বসতেই আটটা বেজে যেত। বিজ্ঞান পড়ে তখন অজ্ঞান, ইতিহাস তখন পাতিহাঁস আর ভূগোল তখন সত্যিই গোল নটার মধ্যে ঘুমে ঢুলতে থাকতাম । সাড়ে ন'টা থেকে দশ'টার মধ্যে বিছানায় ।

এই প্রসঙ্গে খুব মনে পড়ছে একটা কথা যেটা না বল্লেই নয়, আমাদের সময়ে আমরা এক অদ্ভুত 'হবি' রাখতাম তা হল ডাকটিকিট, দেশলাই বস্ক এর উপরের খোলা আর বিভিন্ন প্লেয়ারদের ছবি সংগ্রহ সেটা এক সময় নেশায় পরিনত হয়ছিল আর যার কাছে 'স্পোর্টস স্টার' পত্রিকা সেই সময় থাকত সেই সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী ছিল কারন ঔই পত্রিকা থেকেই প্লেয়ারদের ছবি কেটে বিভিন্নভাবে ভিন্ন ভঙ্গিমায় খাতায় আটকাতে হতো এবং তা বাকায়দা আমার সবাই সবাইকে দেখাতাম 'প্রেজেন্টেশন' এর মত আর এর এক সবচেয়ে পজিটিভ কথা আমার একেক জন ক্রিকেট সমালোচক ছিলাম আর বিশেষ করে আমাদের বন্ধু 'পাহাড়ি' - টা ছিল এই ব্যাপারে মাস্টার আর 'ধাড়া' - টা ছিল বিভিন্ন ধরনের তথ্যের 'পোকা।

আর' সরস্বতী পুজোর আগে থেকেই প্রস্তূতি চলত কিভাবে নিজের বাড়িতে ফুল গাছ বাঁচানোর , রাত রাত জেগে দুই ভাই মিলে গাছগাছালির পর্যবেক্ষণ পূজার দিন রাত জাগা আর সকাল বেলা কিছু না খাওয়ার বাহানায়-'র' চা আর দুই পিস জিরা বিস্কুট মা এর আড়ালে লুকিয়ে বাবা সঙ্গে খেয়ে 'ওং' 'ওং'- মন্তপাঠ করে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া আর স্কুলের সবার সাথে বসে প্রীতি ভোজ-এ গরম গরম খিচুড়ি আর বেগুন ভাজার মজা আজকের ফাইব - স্টার রেস্টুরেন্ট কে হার মানায় আর তারস্বরে পোঙতিতে 'সরস্বতী মাইকি, আসছে বছর আবার হবে' ....

এভাবেই কবে যেন অতি বড় হয়ে গেলাম... এখন তো বুড়ো হয়ে গেলাম । এখন এই মাঝ বয়সে পৌঁছে ভাবি, খুব কিছু আহামরি পড়াশুনা না করেও তো দিব্বি চালিয়ে দিলাম জীবনটা । কেমন নিশ্চিন্তে, হৈ হৈ করে ।

জীবনে, কঠিন দিন কিছু কম দেখলাম না ? নিজের পায়ে দাঁড়াতে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্দ্ধ কিছু কম করলাম না কেবল মাত্র 'বিশ্বযুদ্ধ' আর 'স্বাধীনতা সংগ্রাম' ছাড়া, আর সবই প্রায় তো দেখে ফেলেছি । কুপরির বা লন্ঠনের আলো থেকে ইন্টারনেট, দূরত্বটা কিছু কম নয় । তবুও কত সুন্দর ভাবে সময়ের সাথে সাথি হয়ে মানিয়ে নিয়েছি । তেমন কিছু অসুবিধা হয়নি কাউকে কখনো বুঝতেই দেইনি ।

তাহলে? আগামী প্রজন্মকে নিয়ে এত কেন দুশ্চিন্তা আমাদের?

আপনার, আমার আজকের প্রত্যেক অভিভাবকেরা কেন প্রতি মুহূর্তে দুশ্চিন্তায় থাকি ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ?

- শুধু পড়াশুনা, শুধু কেরিয়ার, শুধু নম্বর, শুধু রেজাল্টের অকারন আশঙ্কায় কেন ওদের শৈশব হারিয়ে যেতে দিচ্ছি আমরা ? কচিকাঁচারা জানলই না, এই বর্ষায় জল-কাদা মেখে ফুটবল খেলার কী আনন্দ ।হাফ-প্যাডেল থেকে ফুল-প্যাডেল সাইকেল চালানোর অবৈজ্ঞানিক উপায়, দেশলাই এর খালি ডিব্বায় বেল গাছে পাওয়া শামুক পালন কিংবা বিপক্ষের আগুয়ান ফরোয়ার্ডের পা লক্ষ্য করে, ‘সররা-মারা’- স্লাইডিং ট্যাকেল করার মজা, ওরা কি আর কোন দিন পাবে ?

(3)

ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা আর কিছু নিজেদের তৈরি তালিবানি ফরমানের পরিণামে মাঠে বন্ধুদের না পেয়ে, বাড়ি ফিরে এসেছে ছেলে । হতাশ মুখে জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে । উদাস চোখে কী যেন ভাবছে?

আকাশ দেখছে আর স্মার্ট ফোনের অতল সমুদ্রের তলে তলিয়ে যাচ্ছে সোশাল ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পওয়ার আশায় ব্যাকুল আজকালকার ছেলেমেয়েদের মনের তল পাওয়া মুশকিল আর এইসব কথা ভেবেই মনে হলো এমনই নিঃসঙ্গ কৈশোরকেই তো টার্গেট করা সোজা । সাদা কালো আরে কি যেন, 'নীল-তিমি' না কি যেন নাম ? মারণ খেলায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে শৈশব ।

আমি নয় খবর বলছে এমনটাই ? তা! ওদের আর দোষ কী বলুন ? এই আনমোল জীবন খুঁজে না পেলে ওরা তো মরণ খেলায় মাতবেই, এটাই তো স্বাভাবিক । শুধু ভাল পড়াশুনা, ভাল কেরিয়ারের দোহাই দিয়ে ওদের শৈশবের সোনালী দিনগুলো, আমরা অভিভাবকরাই তো ঝাপসা করে দিচ্ছি ।

অথচ আমাদের অভিভাবকরা কিন্তু এমনটা করেননি কখনও ‘বড় হতে হবে’ বলে, ছোটবেলাটার ভ্রুন হত্যা করেনি তারা । তাই বোধহয় এই অনুভূতি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম আর সঠিক ও সচ্ছন্দ ভাবে জীবনের সংসার নামক 'তরী' নিয়ে জীবন সমুদ্রের তীরে গেলাম এ যাত্রা ।

না হলে, হয়ত আমাদেরকেও কোন এক ‘নীল তিমি’ খেয়ে ফেলতো ।

।। সমাপ্ত ।।