The shadow of the bodyless books and stories free download online pdf in Bengali

কায়া হীন ছায়া

হঠাৎ করেই দিদি সেদিন বলল, লকডাউনে তো বসেই আছিস। জামাইবাবুর পুকুরগুলোকে একটু দেখতে পারিস তো! আমি তখন আর কিছু না বলে, সন্ধ্যার সময় জামাইবাবুর কাছে যাই। সেখানে তখন এতাই, হাবুল, নাসির, রাজু বসে কি সব আলোচনা করছে। আমি ঢুকতেই, আমায় বসতে বলে। রাজুই আমাকে প্রথম কাজের কথা জিজ্ঞাসা করে। এরা সবাই পুকুর নিয়ে আলোচনা করলেও জামাইবাবু কিন্তু একপাশে বসে ফোনে কিসব পড়ছে।
রাজুর কথায় আমিও পুকুরে কাজ করতে সম্মত হই। তখনই জানতে পারি, কালকের কাজ গহলা পুকুরে হবে এবং আজ রাত বারোটার দিকে বেড়িয়ে পড়তে হবে। কিন্তু গহলা পুকুরের পাশেই শ্মশান। সেখানে রাত বারোটার সময় কি হবে? ওদের আলোচনা থেকে জানতে পারি, পুকুরে জাল নামবে তিনটের সময়। কিন্তু ভোর তিনটের সময় কাকে খুঁজবে! যদি কোন একজন না আসে। তাই আগে থেকেই এখানে থাকতে হবে। তাছাড়া অত বড় পুকুরে অনেক গুলো জাল লাগে। তাই সেগুলো সেলাই করতেও অনেকটা সময় লাগে।
আমিও রাজি হয়ে যাই। ওখান থেকে একবার বাইরে বেড়িয়ে বাড়িতে মাকে ফোন করে জানিয়ে দিই। বাড়িতে খাব না, এখানে রান্না হচ্ছে। যাব একবার, তখন ডিটেলে বলবো। এখন জামাইবাবুর কাছেই আছি। ফোন পকেটে রেখে আবার ভিতরে ঢুকি।
জামাইবাবু পড়া বন্ধ করে এতাইকে কি করতে হবে তা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। এতাই কিন্তু জেলে নয়। তবে সবসময়ই থাকে। কোন্ পুকুরে পানা চাপ হয়ে যাচ্ছে, কোন্ পুকুরে খাবার দিতে হবে, কোন্ পুকুরের পাড় সাফ করতে হবে, এইসব দেখে। জানতে পারি, একটা পুকুরে খেঁজুর গাছ পড়ে আছে। আবার এও জানতে পারি, কালকেই এতাই গাছটিকে পুকুর থেকে তুলিয়ে দেবে।
যাইহোক, আবার গল্পে মেতে উঠি। নানারকম পুরানো অভিজ্ঞতা একে অপরের সাথে শেয়ার করা। আর জামাইবাবু থাকবে, ভূত থাকবে না, তা কি করে হয়! আসলে জামাইবাবু যে কি জানে না, তাই বুঝতে পারি না। একে তো ইঞ্জিনিয়ার, তার উপর আবার ইউ জি সি থেকে আলাদাভাবে পারমিশন নিয়ে অঙ্কে গ্রাজুয়েশন করে একটা হাইস্কুলে চাকরি করে। আবার গলায় একটা পাথরের মালা পড়ে থাকে। যে পাথরগুলি প্রত্যেকটি একটা মানুষের মাথার খুলির মত! জিজ্ঞাসা করলে বলে, এমনিই পড়ি। দিদির থেকে জেনেছি, অনেক দিন আগে একবার তারাপীঠে গিয়ে কয়েকজন বাচ্ছার থেকে হারটা কিনেছিল। বাচ্ছাগুলো বেলেপাথর কেটে কেটে ওগুলো বানায়। কিন্তু যা মজুরি পায় তাতে খাওয়া খরচাও জোটে না!
তারপর থেকে আর জিজ্ঞাসা করি না। কিন্তু আমার মনে হয়, আসলে অন্য কিছু আছে। জামাইবাবু তো প্রায়ই বলে, "আমি শুধু ভূত দেখতে পাই না, সবাইকে ভূতের অস্তিত্ব দেখাতেও পারি।" আর হারটা দেখলেই কেমন যেন তান্ত্রিক তান্ত্রিক বলে মনে হয়। এমনিতে জামাইবাবু চুল দাড়ি বড় বড় রাখে। শুধু পরনের জিন্স শার্ট এর জন্য তান্ত্রিক ভাবতে পারি না।
তা হয়েছে কি, জামাইবাবু বলে, অনেকদিন আগে, একবার এই গহলা পুকুরেই রাতে একা আছি। আমি তো আছি মন্দিরের চাতালে। দিব্যি আলো জ্বলছে। সামনের শিবমন্দিরটা তখনও হয়নি। ওখানটা ঝোপ মতোই হয়ে থাকতো। রাত্রি তখন একটা কি দেরটা হবে। একটু শীত শীত করছে। তাই উইণ্ডচিটারের সামনের চেনটা গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে সবে একটু ঝিমুতে শুরু করেছি, এমন সময়ে সামনের ঝোপটা যেন একটু নড়ে উঠল। হালকা ঝিমুনি ভাব থাকায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। সাথে সাথেই সচেতন হয়ে উঠি। চোখ দুটো একবার কচলে নিয়ে আবার চশমাটা পড়ি।
হ্যাঁ, ঠিকই দেখছি। সামনে ঝোপটার ওই পাশটা একটু বেশি রকমই নড়ছে। কি হয় জানার জন্য ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি। একে তো কাঁটা ঝোপ। তার উপর মাঝরাতে কি থাকতে পারে! আকাশে চাঁদ থাকলেও মেঘের মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে। মায়ের মন্দিরের বারান্দার আলো ঝোপের উপর গিয়ে পড়েছে। পাশের রাস্তার পিটুলি গাছগুলো পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সময় যেন কাটতে চাইছে না। এক একটা সেকেন্ড যে কত বড় তা বুঝতে পারি। অথচ ঝোপের পাশটা নড়েই চলেছে। কেউ বা কারা যেন ঝোপের ভিতর ধস্তাধস্তি করে চলেছে। তা সত্ত্বেও কোন আওয়াজ পাচ্ছি না। তাই শেয়াল কুকুর নিশ্চয়ই হবে না। কিন্তু কে নাড়াচ্ছে?
হাবুল বলে, আচ্ছা দাদা, তুমি কোনদিন ভূত দেখেছো?
নাসির ঝাঁঝিয়ে ওঠে, দিলি তো ফুট কেটে। সব্বে ভুত উঁকি মারতে শুরু করে ছিল!
জামাইবাবু আবার সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করে। ভুত কি আর দেখা যায় রে, ভূত অনুভব করতে হয়। অনেকবার ভুতের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছি। তবে আজকে যেটা বলছি, সেটা নিছকই একটা সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা। প্রথমদিকে ভূত বলে মনে হলেও পরে জানতে পারবি। আর আজকে রাতেই তো গহলা পুকুরে যাবি। সেখানে যদি কিছু থাকে, তাহলে তো দেখতেই পাবি। আজকে আমিও তোদের সাথেই থাকব। যদি আমি বুঝতে পারি, তাহলে তোদেরও বলবো।
রাজু বলে, তারপর কি হল?
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, এটা শ্মশান হলেও, এই কালী মায়ের মন্দিরে একা রাত কাটানো, আমার কাছে নতুন নয়। একাধিকবার এর আগে কোনো কিছু দেখতে পাইনি। কিন্তু একটা কথা কি জানিস তো, যখন কোন ভৌতিক জায়গায় একা রাত কাটাবি, তখন সব কিছুকেই ভৌতিক বলে মনে হয়। দূরের অন্ধকারকে মনে হবে, কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা গেলেও তা দেখে মনে হবে, গাছে কারোর চোখ জ্বলছে যেন। তার সাথে রাত জাগা পাখিদের ডাক তো আছেই। মাঝে মাঝে একটা একটা দমকা হাওয়া, আরও বেশি করে ভূতের ভয় ধরিয়ে দেবে।
এমনিতে ভুত এমন একটা শব্দ, যা সবসময় আমাদের টানে। তাই তো আবার ভূত দেখার জন্য এগিয়ে যাই। সেদিনও রাতে মন্দিরের সামনে থাকা ভুতের জন্যই। কদিন ধরেই রাতে একটা আগুনের গোলা শ্মশান থেকে বেড়িয়ে মাঠের উপর দিয়ে এগিয়ে যায় শুনছি। মাঠের রায়পাড়া, এই রায়পাড়ার অনেকেই দেখেছে।
তা শুনে সেদিন রাতে এখানে থাকা। তাই সব রকম প্রস্তুতি ছিলই। রাতে খেয়ে দেয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। তারপর থেকে একা একা বসে, শুয়ে সময় কাটানো। উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু যখন একনাগাড়ে অনেকক্ষণ ধরে ঝোপের পাশটা নড়েই চলেছে। আমিও শুয়ে শুয়ে দেখছি, আর কি হতে পারে, ভেবে চলেছি। শেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। পাশ থেকে পেন্সিল টর্চটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসি। যেন কিছু দেখতেই পাইনি। কিন্তু আমার চোখ, কান, মন সবই ঝোপের পাশটায়।
মন্দিরের দালান থেকে সামনের দিকে নামি। সোজা রায়পাড়ার রাস্তার দিকে আতি নিঃশব্দে এগিয়ে যাই। এই দিকটা ঝোপের উল্টোদিকে পরে। এক পা এক পা করে এগিয়ে চলি, আবার দাঁড়িয়ে পড়ি। এক সময় ঝোপের পাশে গিয়ে উপস্থিত হই। তখনো ঝোপের উল্টো দিকটা নড়ে চলেছে। কেউ যেন ধুতরা গাছের গোড়া ধরে নাড়িয়ে চলেছে। এখন আর আমি দাঁড়িয়ে নেই। ঝোপের পাশে বসে আস্তে করে টর্চটা জ্বালি।
দুটো গেছো ইঁদুর গাছটার গোড়ায় নিজেদের দাঁত ক্ষয়াচ্ছে। এটা দেখে নিজে হাসবো না ভূতের ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে থাকবো, তা বুঝতে পারি না। কিন্তু তবুও নিজের মনে মুচকি হেসে নেই একটু। তারপরে আবার মন্দিরের দালানে এসে বসি।
যাইহোক মলয়ের কতদূর একবার খোঁজ নিয়ে নে। আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। বেশি রাত না করে খাওয়া দাওয়া করে নে। এখান থেকে ঠিক সাড়ে বারোটায় বেরোবো।
জামাইবাবু বেড়িয়ে গেলে হাবুল বলে, একটা বিড়ি দে তো। ইঁদুরটা এসে ভূত ভাগিয়ে দিয়ে গেল। তবে আজকে দাদা ভূত দেখাবে বলেছে।
এই বলে বিড়িটা ধরিয়ে, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, মলয়! বলে চেঁচিয়ে ওঠে। পাশের ঘর থেকে মলয়ও একটা থালায় করে খানিকটা মাংস তুলে এনে বলে, ততক্ষণ টেস্ট করো। আর আধ ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে যাবে।
সবাই একসাথে খালার উপর প্রায় হুমড়িয়ে পড়ে। হাবুল বলে, ওরে আমার জন্য একটা পিস রাখিস।
নাসির বলে, এটুকু খেলে খিদে যেন বেড়ে যায়!
তোর খালি সব সময় খাই খাই। এত খেয়ে কি করে হজম করিস বল তো!
আরে খাওয়ার লেগেই তো সবকিছু। না খেলে কি করে কাজ করবি বল! শক্তি পাবি কোথা থেকে? নে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। তারপর আবার অনেক কাজ পড়ে আছে। জাল গাঁথতে হবে। কথা বলতে বলতে খাওয়া চলতে থাকে।
মলয় আরেকটু দিয়ে যা ভাই, পরে না দিলেও হবে।
যাই গো এতাইদা। বলে মলয় আরো একটু মাংস তুলে দিয়ে যায়।
যাই বলোনা কেন, মলয় কিন্তু মাংসটা ভালোই রাঁধে!
সেবারে শুটকি মাছ যা রান্না করেছিল না, এখনো যেন মুখে লেগে আছে, রাজু বলে।
মাংস খেতে খেতে তোকে আর শুটকি মাছের গল্প করতে হবে না। এখন মাংস খাচ্ছিস খা। না হলে পরে আর তাও পাবি না। আমিও মাংস খেতে থাকি। সত্যি মলয় যেন কি অপূর্ব রেঁধেছে। মাংসগুলো যেমন ভাল সিদ্ধ হয়েছে, ঠিক তেমনি মশলাদারও হয়েছে। এটা ওটা গল্পও চলতে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মলয় এসে জানায়, খাবার রেডি। কে কে খাবে, বসে পড়ো। এটা শুনে আমরাও পাশের ঘরে ঢুকি। আমাদের সবারই একসাথে হয়ে যাবে। কিন্তু, রাজু খাবে না। বাড়িতে খেতে যাবে। তিনটের আগেই গহলা পুকুরে চলে আসবে। আমরাও খাওয়া শুরু করি।
মোটামুটি তখন হয়তো পৌনে বারোটার মত হবে। আমি খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। মাকে বলে, গামছা নিয়ে রেডি হয়ে চলে এসেছি। এতাই, নাসির, হাবুল, মলয় এখানেই ছিল। জামাইবাবুও চলে এসেছে। নাসির বাইরে তক্তোবোসে শুয়ে নাক ডাকছে। হাবুল আর এতাই বাইরে নিম গাছের গোড়ায় বসে একটা মোবাইলে কি যেন দেখছে! আমি এগিয়ে গেলে, এতাই আমাকেও দেখায়। একটা পুকুরে কি রকম পানা চাপ হয়ে গেছে। সত্যি, এবার না মাছ মারা যায়!
জামাইবাবু বলে, আর একটু পরে বেরোব। পলাশকে একবার ফোন কর না।
ও রাজুর সাথে একসাথে চলে আসবে।
তাহলে দুখীদা এলেই বেড়িয়ে পড়বো। ওখানে একটু গড়িয়ে নিতে পারবি। ঐতো, দুখীদাও এসে গেছে।
দুখীদার গাড়িতে শুধু দুটো বড় বড় হাড়ি তুলতে হবে। বাকি সবকিছু গহলা পুকুরের পাশেই আছে। ওখানে একটা টিনের ঘরে জাল হাড়ি থাকে। আগে এই ঘরটা ছিল না জামাইবাবুই করিয়েছে। এখন সবাই ব্যবহার করে। আর জামাইবাবুও জাল হাড়ি রাখে।
সবাই একসাথে বেড়িয়ে পড়ি। এতাই আর হাবুল নিজের নিজের বাইকে। আমি, মলয়, জামাইবাবু দুখীদার ভুটভুটিতে। একটুখানি রাস্তা। সাথে সাথেই পৌঁছে যাই। রাস্তার পাশেই একটা খেলার মাঠ। তারপরই গহলা পুকুর। এই মাঠ, পুকুর, পাশের কালী মন্দির সংলগ্ন জায়গা সবই শ্মশানের সম্পত্তি। পিচ ঢালা রাস্তা থেকে একটা ইটের রাস্তা বেড়িয়েছে। যেটা শ্মশানের পাশ দিয়ে মাঠের উপর দিয়ে গিয়ে রায়পাড়ার ভিতরে ঢুকে গেছে। পিচ ঢালা রাস্তার মোড়ে একটা ইলেকট্রিকের বাতি জ্বলে। কিন্তু এই আলোটা এখানে লাগানোর দিন থেকেই ভৌতিক নিয়মে চলে। মানে, নিজের খুশি মতো কখনো জ্বলতে থাকে, আবার কখনো নিভে যায়।
অনেক ইলেকট্রিক মিস্ত্রি দেখানো হয়েছে, বারবার লাইট, হোল্ডার পাল্টানো হয়েছে। কিন্তু নেভা জ্বলার নিয়মের কোন পরিবর্তন হয় নি। এখন তো সবাই জেনে গেছে।
আমরা যখন ওই বিদ্যুৎ-বাতির নিচটা দিয়ে পাস হচ্ছি, ঠিক তখনই আলোটা নিভে গেল। আবার আমরা সবে পিচ ঢালা রাস্তা থেকে ইটের রাস্তায় নেমেছি, আলোটা আবার জ্বলে উঠলো। হঠাৎ জামাইবাবু বলল, দুখীদা, বাঁদিকে মাঠের ওপর দিয়ে ঘাটের কাছে চলো। দুখীদাও সেইমতো ঘাটের পাশে গাড়ি রাখলো। আমরা নেমে পড়লে, গাড়িটাকে ঘুড়িয়ে রাখলো।
ততক্ষনে নাসির আর হাবুল জাল গুলোকে বের করা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু নাসির তো বাইরে তক্তবোসে ঘুমাচ্ছিল! কি হলো ব্যাপারটা! মাথায় ঢুকছে না তো!
যাইহোক, আমি, মলয়, এতাই মন্দিরের দালানের দিকে এগিয়ে যাই। একটু গড়িয়ে নেয়া আর কি। একটু পরেই তো উঠে পড়তে হবে। শুয়ে শুয়েই দেখতে পাই, শ্মশানের মুখ থেকে সোজা ঘাটের পাশ দিয়ে যে অংশটায় সিমেন্ট করা আছে, সেখানে নাসির আর হাবুল জাল মেলছে। একটার পাশে একটা করে পরপর অনেকগুলো জাল সাজিয়ে রাখে। জামাইবাবু ঘাটের চাতালে বসে পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের দিকে তাকিয়ে আছে।
ওই দিকে মাঠের উপরে কয়েকটা সিমেন্টের ডাবা বসানো আছে। ঐ ডাবা গুলোতেই খোল পচানো হয়। পুকুরের কোনে অনেকটা অংশ মোটা জাল দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। সেখানেও খাবার তৈরি করা হয়। আমি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ি।
কিন্তু বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। একে শ্মশান! তার উপর পাশে রোগা-পাতলা মলয় এমন বিশ্রীভাবে নাক ডেকে চলেছে! তাতে কি আর ঘুমানো যায়! তাই শুধু শুধু শুয়ে না থেকে, উঠে পড়ি। ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই।
জামাইবাবুর এখন খালি গা। গলায় পাথরের হারটির সঙ্গে আজকে একটা রুদ্রাক্ষের মালাও আছে দেখছি। আমি ঘাটের কাছে যেতেই, উত্তর-পশ্চিম দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে জামাইবাবু জিজ্ঞাসা করে, কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
পাশে রাখা টর্চটা নিতে যেতেই, ওইদিকে আলো মারতে নিষেধ করে। বলে, যে আলো আছে তাতেই চোখ সইয়ে নিয়ে দেখ।
ততক্ষনে আমার পাশে এতাই আর হাবুলও চলে এসেছে। হাবুল বলে, দাদা বিট্টুকে একটু আগে তোলা ছবিটা দেখাও।
কেন? কি হয়েছে? কিসের ছবি?
আস্তে, আস্তে। একসাথে অতগুলো প্রশ্ন করলে উত্তর দেবো কেমন করে? তাছাড়া যে ছবি তোলা হয়ে গেছে তা পরেও দেখতে পাবি। এখন খালি চোখে যা দেখতে পাচ্ছিস, দেখে নে। সব সময় দেখা যায় না।
ওদিকে কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। সবই আগের মতন। চাঁদের আলোতে যা দেখা যাচ্ছে তাতে অতিরিক্ত কিছু তো পাচ্ছি না। ঐ তো, ওখানে ডাবাগুলো আছে, আরেকটু এগিয়ে গেলে ঘেরাটা পড়বে।
ঘেরাটার সামনে দেখ।
কিছু দেখতে পাচ্ছি না তো!
ঠিক আছে, একটুখানি দাড়া। তার পরে দেখাচ্ছি, বলে জামাইবাবু একবার টিনের ঘরটার ভিতরে চলে যায়। এই ঘরটার ভিতরটা অন্ধকার। আমরা বাইরে বসে থাকি। এতাই আর হাবুলও জানায়, কিছু দেখতে পায়নি। কিন্তু জামাইবাবু কি দেখার কথা বলছে? আর টিনের ঘরের ভিতরে অন্ধকারে জামাইবাবু কি করছে? কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি না হয় ভূতের ভয় পাই। কিন্তু এতাই, হাবুল, নাসির, এরা তো ভূতে বিশ্বাসই করে না। আর হাবুল কি ছবির কথা বলছিল, মনে হতেই জিজ্ঞাসা করি।
হাবুল বলে, একটু আগে আমি আর নাসির তখন জাল গাঁথছি। দাদা ঘাটের রকে বসে বটগাছের ভিতর দিয়ে চাঁদের ছবি তুলছিল। হঠাৎই একটা ছবি তোলার পরে বলে, হাবুল, আজকে জাল দিলেও মাছ পড়বে না। আজকে কাবার করে ফেলতে পারিস। আমি জিজ্ঞাসা করি, কেন গো দাদা। দাদা বলে, তেনারা এসে পড়ে বেশিরভাগ মাছকে সরিয়ে দিয়েছে। ওদের নিজের নিজের আলাদা গর্ত রয়েছে। যেখানের সাথে এই পুকুরের জলের কোন যোগাযোগই নেই।
তাই আবার হয় নাকি!
না হয়, একটু পরেই দেখতে পাবি।
আমি আর তর্ক বাড়াই না। তখন দাদাই দুটো ছবি দেখায়। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, টিনের ঘরের উপর থেকে কে যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে রাখা মাছের হাড়ি গুলোকে দেখছে। আর একটা ছবিতে শ্মশানের সামনে থেকে একটা অস্পষ্ট ছায়া এগিয়ে আসছে। পাশের নাসির তখনও জাল গাঁথতে ব্যস্ত। আমি দাদার পাশে দাঁড়িয়ে। ওই তো দাদা এসে গেছে।
খুব সাবধানে ঐদিকে টর্চ জ্বালাতে পারিস। তবে ওদের দিকে আলো ফেললে, ওরা কিন্তু খুব রেগে যায়। ওরাও সাথেসাথে সিগন্যাল দেবে। ভয় পাবি না।
কি করবে ওরা?
একবার টর্চটা জ্বেলেই দেখ না। কিছু দেখতে পাস কিনা? আমি তো ভুল দেখছিও হতে পারে।
তবে জ্বালাই। বলে মাঠের উপরে টর্চটা মারি। ঐ তো সিমেন্টের ডাবা গুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। টর্চের ফোকাসটা যেইমাত্র পুকুরের জলে পড়ল, নতুন মন্দিরের দেওয়ালে হঠাৎই ফ্লাশ হতে শুরু করল। কিছু দেখার আগেই টর্চটা নিভিয়ে ফেলি। এতাই আর হাবুলও আমার মতই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
মুহূর্তেই সামলে নিয়ে এতাই বলে, ওখানে ইলেকট্রিকের যে তারটা আছে, সেখানে কোন কারনে ফ্লাশ হয়েছে।
ঠিক আছে, আর একবার জ্বালা।
না, আমি আর জ্বালাবো না। এতাই, তোর দরকার হলে, তুই জ্বালা। এতাই তখন টর্চটা জ্বালায়। সাথে সাথেই নতুন মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে ফ্লাশ। এতাইও টর্চটা অফ করে দেয়। মন্দিরের দেওয়ালের ফ্লাশও বন্ধ হয়ে যায়।
খুব স্বাভাবিক ভাবে বোঝ। তোর চোখে কেউ টর্চ মারলে তুই কি করবি?
আমিও আমার হাতের টর্চ তার মুখে মেরে, কে এমন কাজ করছে জানতে চাইবো।
এখানেও ঠিক তেমনি হচ্ছে। তবে ওখান থেকে এখন ওরা চলে যাচ্ছে। উত্তর পূর্ব দিকের কোণে যে বটগাছটা আছে, সেদিকে এখন দেখতে পাচ্ছি। এখন ডাবার দিকে টর্চ মারলে কিছু হবে না। পরীক্ষা করে দেখতে পারিস। তবে বটগাছের দিকে এখন আর টর্চ মারিস না। দে টর্চটা দে, বলে এতাই এর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে জামাইবাবু ডাবার পাশ থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম কোণের গাছপালা সব জায়গাতেই টর্চের আলো ফেলে।
সত্যি, এবার কিন্তু কিছু হল না। আমিও জামাইবাবুর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে ওই কোণের দিকে ভয়ে ভয়ে জ্বালি। না, এখন সত্যিই কিছু হচ্ছে না তো! ও, তাহলে হয়তো এতাই এর কথাই সত্যি। কোন কারনে ইলেকট্রিকের তার থেকে ফ্লাশ হচ্ছিল। এইসব ভাবতে ভাবতে টর্চটা ঘোরাতে থাকি। পুকুরের ধার ধরে পশ্চিমদিকের মাঠ বরাবর টর্চ জ্বেলে দেখতে থাকি। কিছুই হয় না। তাছাড়া সবার মাঝে আছি, কিই বা হবে! টর্চটা নিভিয়ে ফেলি। মন থেকে কিন্তু ফ্লাশের খটকাটা কিছুতেই যায় না।
ঘাটের কাছ থেকে মন্দিরের দিকে যাই। এখানে মলয়ের পাশে এখন দুখীদাও শুয়ে আছে। থাক, ঘুমিয়ে নিক। একটু পরেই তো উঠতে হবে। আবার ঘাটে ফিরে আসি। নাসিরের জাল গাঁথা হয়ে গেছে। কিন্তু রাজু, পলাশ, প্রশান্ত এখনো আসেনি। ঘড়িতে দেখি, দুটো কুড়ি। এতাই ঘাটের চাতালে শুয়ে আছে। জামাইবাবু আর হাবুলকে দেখতে পাই না। আমি কাছে আসতেই টর্চটা একবার উত্তর-পূর্ব কোণের বটগাছের দিকে মারতে বলে।
আমি পারবো না। তোর দরকার হয়, তুই টর্চ নে। বলে টর্চটা এগিয়ে দিই। আমার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে বটগাছে মারতেই, নতুন মন্দিরের দেওয়ালের তিনটে থাম জুড়ে ফ্লাশ হতে থাকে। কিন্তু একটা থাম পর্যন্ত না হয় তার আছে। মাঝের দুটো থামে তো কিছু নেই। আমি এতাই এর হাত থেকে টর্চটা কেড়ে নিয়ে নিভিয়ে দিই। আস্তে আস্তে ফ্লাশও বন্ধ হয়ে যায়। এটাকে ভৌতিক বলব, না অন্য কিছু, বুঝতে পারি না। দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বসে থাকি।
কিছুক্ষণ পরে রাজুরা এসে হাজির হয়। তারপর পুকুরে জালও নামানো হয়। পুরোটা ঘুরে আসার পর, যখন জাল ঝাড়া হয়, তখন জামাইবাবুর কথা না মানা ছাড়া উপায় থাকে না। এত বড় পুকুরে জাল ঘোরানোর পর সর্বসাকুল্যে কেজি পাঁচেক মাছ পড়েছে। হাবুল আর একবার জাল ঘোরানোর কথা বললে, জামাইবাবু বারণ করে। বলে, আগে কাবারের ওষুধটা মেরে দে, তারপর একবার জাল ঘোরা। আগেই বললাম তো, আজকে মাছ পড়বে না। আমাদেরও মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।