Ghost wedding house books and stories free download online pdf in Bengali

ভৌতিক বিয়ে বাড়ি

বিয়েবাড়ির খাওয়াদাওয়ার পর নিশান ঘড়িটা দেখে বললো, “ইস কলকাতার ট্রেন এখনো দেড় ঘন্টা । কি করবে ততক্ষণ চিত্রা ! উঃ কি গ্রাম-গ্রাম জায়গা । মশাও আছে ।”
আমি বললাম, “কী মুশকিল, এটা তো গ্রামই । আগে ভাগে খেয়ে নিলাম, বিয়েটা একটু দেখে যাই বরং ।”
নিশান হতাশ ভাবে এদিক ওদিক তাকালো । সত্যিই গণ্ডগ্রাম যাকে বলে । নিশানের অফিসের এক বয়স্ক ভদ্রলোকের ভাইঝির বিয়ে । অসীমবাবু নিশানকে একাধিক সূত্রে বহুদিন ধরে ভালো করে চেনেন, সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন আমাদের আসতে । কলকাতা থেকে ঘন্টা আড়াই মতো, দিনে দুটো ট্রেন । আমরা দুপুরেই পৌঁছেছি । ওঁরা রাত্রে থেকে যেতে বলেছিলেন কিন্তু আমরা আটটার ট্রেন ধরেই ফিরে যাবো ঠিক করেছি । কাল অনেক কাজ আছে ।
এবাড়িটা দোতলা পাকাবাড়ি, তবে টালির চালের মাটির ঘরও আছে সংলগ্ন । গ্রামটায় অনেক বাড়ি এরকম । প্রচুর ঝুপসি মতো গাছপালা । ইলেকট্রিকের আলো আছে তবে টিমটিমে । হ্যাজাক জ্বলছে ।
বললাম, “কেন আমার তো বেশ লাগছে ! গ্রামের বিয়ে আমি কখনো দেখি নি । আর রান্নাটা কী ভালো হয়েছে, আমি ফিসফ্রাইটা...।”
থেমে গেলাম । পাশেই শামিয়ানার নিচে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্হা, সেখান থেকে একটা গোলমালের শব্দ । এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটা বছর ছ সাতের ছোট্ট ছেলেকে ঘিরে চ্যাঁচামেচি হচ্ছে । বাচ্চাটির গলায় বোধহয় কিছু আটকেছে, সে প্রাণপণে কাশার চেষ্টা করছে, মুখ হাঁ, চোখ মুখ লাল, হাত মুঠো, পাশে এক মহিলা ওকে ধরে আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলছেন “ছোটন, ছোটন...”, সবাই কথা বলছে একসঙ্গে । “গলায় কি আটকালো....ইস, ডাক্তার আছে কেউ...মাংসের টুকরো আটকেছে বোধহয়....কেন যে এইটুকু বাচ্চাকে খেয়াল রাখে না...।” আমি আর কিছু ভাবলাম না, মুহূর্তে এগিয়ে গিয়ে মহিলাটিকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম । পিছন থেকে ছেলেটিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওর বুকের খাঁচার নিচে নাভির উপরে নিজের একহাত মুঠো করে অন্যহাতে সেটা চেপে ধরে সজোরে একটু ভিতরে ও ওপরদিকে ধাক্কা দিলাম । একটা হেঁচকি মতো শব্দ করে বাচ্চাটির মুখ থেকে কি একটা খাবারের টুকরো ছিটকে বেরিয়ে গেলো । সে “মা” বলে চিৎকার করে হাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ।
সবাইয়ের প্রশ্ন, কৃতজ্ঞতা, প্রশংসার উত্তরে আমি কোনোমতে বললাম, “হাইমলিখ্ ম্যান্যুভার ওটা, কলেজে একটা ফার্স্ট এড ক্লাসে শিখেছিলাম...।” বাচ্চাটির মা আমার হাত চেপে ধরে প্রায় কেঁদেই ফেললেন । ভারি অস্বস্তি হচ্ছিলো । ফোনের মেসেজ টুং করতেই সেই অছিলায় একটু দূরে সরে গেলাম । নিশান আমার সঙ্গে এলো ।
ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো । নিশান বললো, “চিত্রা ? কি হয়েছে ?”
“বাবা, আমার বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে একটা, হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সার্জারি হবে বোধহয়...দাদার মেসেজ, এইমাত্র এলো, কানেকশান হচ্ছিলো না...নিশান, কী হবে এখন....।”
“শ্ শশশর, দেখি ফোনটা...।” আমার কাঁধে একটা হাত রেখে নিশান ফোনটা দেখলো । তারপর দাদাকে ফোন করার চেষ্টা করলো আমাদের দুজনের ফোন থেকেই । কানেকশান হলো না । আমি মা আর দিদিকে কল করার চেষ্টা করলাম । একই অবস্হা ।
“নিশান, আমাদের এক্ষুণি যাওয়া দরকার... ট্রেনে করে পৌঁছতে সেই সাড়ে দশটা বেজে যাবে ...বাবার যদি কিছু হয়ে যায়...।” আমি কাঁদছিলাম ।
“দাঁড়াও দাঁড়াও, শান্ত হও । মেসেজে তো বলেছে সুমন উনি এখন মোটামুটি স্টেবল...অত অস্হির হয়ো না । আমি একটু ট্রেনের ব্যাপারে অসীমবাবুকে জিজ্ঞেস করি ।”
কিন্তু জানা গেলো ওই একটিই ট্রেন কলকাতা ফেরার । এখান থেকে কলকাতা যাওয়ার বাস বা ভাড়া গাড়ি পাওয়া যাবে না এখন, গাড়ি করে গেলে দেরিও অনেক হবে । ভালো রাস্তা নেই । বিয়েবাড়ির নানা ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের এই সঙ্কটে ওঁরা যথেষ্ট বিব্রত হয়ে পড়লেন, কিন্তু কিছু করার নেই । আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না । নিশানকে বললাম, “চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি, স্টেশনে অপেক্ষা করবো না হয়, ওখানে গিয়ে একটু খবর নিলে হয় তো কিছু একটা উপায় হবে ।“
বাড়ির লোকেরা সঙ্গে কাউকে দিতে চাইলেন স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য । নিশান বললো, “না না কোনো প্রয়োজন নেই, আপনারা সকলেই এখন ব্যস্ত, এই তো সোজা গিয়ে তারপর ডানদিকে খানিকটা গেলেই, সমস্যা হবে না ।...আচ্ছা, আমরা এগোই তাহলে...ইয়ে, অনেক ধন্যবাদ...হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা খবর দেবো, অফিসে দেখা হবে...চিত্রা, চলো ।”
গ্রাম্য রাস্তাটার দুদিকে গাছপালা ঝুঁকে পড়েছে, ঘরবাড়িগুলো মনে হয় বেশ দূরে দূরে । মিটমিটে আলো জ্বলছে দেখা যাচ্ছে । বিয়েবাড়ি থেকে যতো দূরে চলে আসছি, অন্ধকার ততো ঘন হয়ে আসছে ।
একটা হোঁচট খেতে নিশান আমায় ধরলো । “আস্তে, চিত্রা ।”
“উঃ, কেন যে মরতে এখানে এসেছিলাম ।”
“তখন কি আর জানতাম আমরা...তোমার ব্যাগে একটা টর্চ ছিলো না ?”
খানিকটা এগিয়ে ডানদিকে মোড় ঘুরতেই দেখি কে একজন যেন হনহন করে এগিয়ে আসছে । এখানে একটা ল্যাম্পপোষ্ট রয়েছে, তার মৃদু আলোয় দেখি একজন ধুতিপাঞ্জাবি পরা ছড়ি-হাতে বয়স্ক লোক, একমাথা পাকা চুল । আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন ।
“তোমরা অসীমের বাড়িতে এসেছো তো ! এদিকে কোথায় যাচ্ছো বাবা ?”
“নমস্কার, আমার নাম নিশান রায়, এই আমার স্ত্রী চিত্ররূপা । স্টেশনে গিয়ে কলকাতার ট্রেন ধরবো ।”
“কিন্তু আজ রাত্রে তো ট্রেন পাবে না বাবা তোমরা । খবর পেলাম আগের স্টেশনের কাছে ওভারহেড তার ছিঁড়েছে না কি যেন । কখন সারাবে ঠিক নেই । এখানেই থাকতে হবে তোমাদের রাত্রে । কাল সকালে তখন...।”
আমি বোধহয় মুখে হাত চাপা দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করেছিলাম । বৃদ্ধ আমার দিকে ভালো করে তাকালেন ।
“কি হয়েছে, মা । ওহো - তুমিই তো ছোটনকে বাঁচিয়েছিলে আজ তাই না । ওর একটা বিরাট ফাঁড়া ছিলো এই সময়, তোমার জন্যই সেটা কাটলো আজ । আমি ছোটনের ঠাকুর্দা । কিন্তু তোমাদের খুব বিচলিত মনে হচ্ছে ? কোনো সাহায্যর প্রয়োজন ?”
সেই প্রায় অন্ধকার গ্রাম্য পথে দাঁড়িয়ে নিশান সংক্ষেপে ব্যাপারটা বললো ওঁকে । উনি চিন্তিত ভাবে চুপ করে রইলেন । আমি কান্না সামলাতে সামলাতে বললাম, “বাবার সঙ্গে আর বোধহয় আমার দেখা হবে না...।”
নিশান বললো, “আর কোনোভাবে কলকাতা ফেরা যায় না এখান থেকে ? মানে আজ রাতে ।”
উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন । হঠাৎ যেন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে বললেন, “শোনো তোমরা, একটা উপায় আছে হয়তো । কিন্তু ব্যাপারটা...একটু জটিল, বিপজ্জনকও হতে পারে, তবে সাবধানে থাকলে ভয় নেই...।”
কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু উদগ্রীব হয়ে বললাম, “কি উপায় বলুন কাকু, আমরা যাবো ।”
নিশান বললো, “গাড়ি ভাড়া করে, বা...।”
“না, সেরকম কিছু নয় । সাধারণত এসব কাউকে বলি না...। তবে কতকগুলো নিয়ম আছে, সেগুলো মানতে হবে, নইলে সমস্যা হবে ।”
“নিয়ম ?”
“হ্যাঁ, আমি বুঝিয়ে দেবো তোমাদের । আচ্ছা, এসো আমার সঙ্গে ।”
ওপাশের ঝোপগুলোর আড়ালে একটা সরুমতো রাস্তা ছিলো, বৃদ্ধ আমাদের নিয়ে সেটা ধরে এগোতে লাগলেন । কোন দিকে যাচ্ছি বুঝতে পারলাম না । বাড়িঘরও চোখে পড়ছিলো না । একটা ভাঙা মন্দির পেরোলাম, একটা মজে যাওয়া পুকুর, বড়ো বড়ো গাছ, পোড়ো জমি । আমি নিশানের হাতটা চেপে ধরে বললাম, “কোথায় যাচ্ছি গো ? ভয় করছে আমার ।”
বৃদ্ধ আমাদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে শান্তভাবে বললেন, “ভয় নেই মা ।”
আরো খানিকক্ষণ হেঁটে একজায়গায় থামলাম আমরা । মনে হল চারধারটা একটু পরিষ্কার হয়েছে যেন । ম্লান চাঁদের আলোয় দেখলাম একটা প্ল্যাটফর্মের মতো জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি । মাথার ওপর একটা হেলে পড়া ছাউনি-মতো । একটা ভাঙা কাঠের বেঞ্চি । পাল্লা-হীন দরজা-জানলা-দেওয়া পুরোনো একটা খুপরি ঘর । সামনে দিয়ে মরচে-পড়া রেল-লাইন বেঁকে দুদিকে চলে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে । বুঝতে পারলাম এটা একটা পরিত্যক্ত রেল স্টেশন । নিশান আর আমি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম ।
বৃদ্ধ বললেন, “এইখানে দাঁড়াও তোমরা, হ্যাঁ ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় । এখানে একটা ট্রেন আসবে একটু পরে ।”
নিশান অবাক হয়ে বললো, “ট্রেন আসবে ? এইখানে ? সে কি !”
“প্রশ্ন কোরো না, অবিশ্বাস কোরো না ।” আলো-আঁধারির মধ্যে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হলো । “ভালো করে শোনো নিয়মগুলো । কি নাম বললে তোমাদের - নিশান, চিত্ররূপা - এই নিয়মগুলো অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে তোমাদের, তা না হলে - বিপদ হবে ।”
আমার মনের ভেতরটা কেমন আবছা লাগছিলো । নিশান বললো, “আপনি বলুন । আচ্ছা - টিকিট লাগবে না ?”
“না । এখানে, তোমাদের সামনে যে দরজাটা পাবে, ঠিক সেই কামরায় উঠে পড়বে, ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে । দরজা বন্ধ করবে কিন্তু লক করবে না । তারপর, তোমাদের কামরায় একজন উঠবে, এখানে নয়, অন্য কোথাও থেকে । তার সঙ্গে কোনো কথা বলবে না । তার কথার কোনো উত্তর দেবে না । সে কিছু দিলে নেবে না । চেষ্টা করবে তার দিকে না তাকাতে। ঠিক আছে ?”
নিশান বললো, “আচ্ছা ।” মনে হলো ওর গলা কেঁপে গেল একটু । “কিন্তু সে কে ?”
“তা বলা যায় না । এই ট্রেনটা অনেক জায়গায় দাঁড়াবে । তোমরা কোথাও নামবে না । কারো সঙ্গে কথা বলবে না । কিছু কিনবে না । বুঝেছো ?”
এবার আমি বললাম, “বুঝেছি ।”
“এইভাবে তোমরা পৌঁছে যাবে । হাওড়ার প্ল্যাটফর্মে নেমে যেয়ো, পিছনে না তাকানোই ভালো । “
নিশান বললো, “কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে ?”
“ওই ট্রেনে সময় বলে কিছু হয় না । তোমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেখবে, তোমাদের হিসেবে বেশি সময় কাটে নি ।” বৃদ্ধ ক্ষীণ হাসলেন । “আর একটা কথা । জানি এ সব হয়তো এই মুহূর্ত তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না । স্বাভাবিক । কিন্তু হবে । আর এ সব কথা কাউকে বোলো না, কেমন ? অবশ্য বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না তোমাদের । কেউ পরে প্রশ্ন করলে বোলো, আমি তোমাদের একটা গাড়ি ধরিয়ে দিয়েছি, সেটা সামনের কোনো স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে ।”
কি বলবো বুঝতে না পেরে আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম । নিশান গলা ঝাড়া দিয়ে বললো, “আপনি...মানে আপনি কি করে এ সব জানলেন...এই সমস্ত ব্যাপার..।”
“ও সব কথা থাক । তোমরা বিপন্ন, আর এই মা আমার নাতিকে বাঁচিয়েছে, তাই আমি সাহায্য করছি শুধু । আশা করি এই প্রয়োজন তোমাদের আর কখনো হবে না । এ ব্যাপারটা আমাদের চেনা ছকের বাইরে তো । আমি যা বললাম মনে রেখো । অনেক কিছু দেখবে হয়তো । চেষ্টা করবে অগ্রাহ্য করতে । অন্য নিয়মে চলে সে সব, এ জগতের কিছু নয় তারা । আমি চলি এবার ।”
“আপনি থাকবেন না ?”
“না । শুধু যারা যাচ্ছে তারাই থাকতে পারে । সময় হয়ে এসেছে । সাবধানে যেয়ো তোমরা । শুভমস্তু ।” দ্রুত পা ফেলে গাছপালার আড়ালে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন ।
“নিশান ?”
“হুমম?”
“কি হলো এটা ?”
“বুঝতে পারছি না ।”
আমি একটা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । বাঁ দিক থেকে প্রায় নিঃশব্দে দুটো মৃদুশক্তির আলো এগিয়ে আসছে । ট্রেন । আমাদের সামনে থামলো । নিশান আমার হাত ধরলো, ঠিক সামনের কামরায় উঠে পড়লাম আমরা । ট্রেনটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিলো । আমি ওপাশের জানলার ধারে একটা সীটে বসে পড়লাম, নিশান আমার পাশে বসলো । ঠিক এইরকম কামরা কোনো ট্রেনে দেখি নি । সীটগুলো খুব বড়ো, আরামদায়ক । দেওয়ালে সবুজ রঙ, অদ্ভুত সব ছবি আঁকা, কী সমস্ত লেখা । চেনা-চেনা মনে হলেও ঠিক চিনতে পারছি না । কোথাও আলো জ্বলতে দেখছি না, কিন্তু ভেতরটা অন্ধকার নয় । খুব জোরে যাচ্ছে ট্রেনটা ।
নিশান দেখলাম ওর ফোনটা পকেট থেকে বের করেছে । ভুরু কুঁচকে বললো, “এ কী । কোনো পাওয়ার নেই না কি, পুরো অন্ধকার স্ক্রীন ।”
আমার ফোনটা বের করে দেখলাম, একই অবস্হা । চার্জার ছিলো ব্যাগে, সেটা লাগিয়েও কোনো লাভ হলো না । আমরা দুজন পাশাপাশি বসে রইলাম । একটুক্ষণ পরে বললাম, “ওই ভদ্রলোকের কথা শুনে কি রকম যেন লাগছিলো । এই পুরো ব্যাপারটা....।”
”হ্যাঁ - অবিশ্বাস্য ।”
ট্রেনের গতি সামান্য কমে আসছিলো । জানলার বাইরে দেখলাম, দুদিকেই খোলা মাঠ চলে গেছে দিগন্ত অবধি । চাঁদের আলোয় থমথম করছে । নিশান বললো, “চাঁদ !। চিত্রা দেখো ওদিকের জানলা দিয়ে ছোট্ট সরু একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে । দেখেছো ? আচ্ছা এবারে আমাদের জানলা দিয়ে দেখো । আরেকটা, প্রায় আধখানা চাঁদ ।”
“দুটো চাঁদ ! সে কি করে হয় নিশান ।”
“জানি না চিত্রা ।”
অদ্ভুত এক জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করে বাইরেটা । ট্রেনের গতির সঙ্গে দিগন্ত ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে । পাথুরে রুক্ষ জমি এখন, মাঝে মাঝে বিশাল উঁচু বাড়ি - না, বাড়ির কঙ্কাল, মানে লোহার খাঁচা দাঁড়িয়ে আছে । তাদের ছায়াগুলো আশ্চর্যভাবে বিভিন্ন কোণে পড়েছে, একদিকে নয় ।
ট্রেনটা থেমে যায় । দরজাটা খুলে কে যেন ওঠে । ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করে । খুব দ্রুত ।
যে উঠেছে সে এক মাঝবয়সী মহিলা । দামি শাড়ি পরা, পলকের জন্য চেয়ে দেখি তার সুশ্রী মুখ, কপালে টিপ, চুলে একটা খুব লম্বা বেণী । কিরকম অস্বস্তি হয় তাকে দেখে, আমি মুখ ফিরিয়ে নিই তাড়াতাড়ি । নিশান নিচু গলায় বলে, “ওর দিকে তাকিও না ।”
মহিলাটি খানিকটা দূরের একটা সীটে বসে বলে, “ও মা, তোমরা এই কামরায় আছো বুঝি । কোথায় যাবে তোমরা ?” ওর গলা সহৃদয়, কিন্তু কেমন একটা ধাতব ঝঙ্কার রয়েছে, একটা যান্ত্রিকতা । আমরা কেউ উত্তর দিই না ।
সে বলে, “কথার উত্তর দাও না কেন ! তোমাদের নাম কি ? আমার নাম জানতে চাও না ? আমি বলতে পারি । আমি তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি তোমরা জিজ্ঞেস করলেই । আমি না, সব জানি ।”
আমরা চুপ করে থাকি । সে হাসতে থাকে, হাসিটা আমার মাথার ভিতরে ধাক্কা দিতে থাকে ।
“ভয় করছে, না ? শোনো, আমি আসলে তোমাদের নাম জানি । হি-হি-হি । এই যে মেয়ে, তোমার বাবার জন্য খুব চিন্তা করছো, আহা । তোমার বাবা কেমন আছেন জানতে চাও না ? আমি জানি কিন্তু ।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে চোখ নামিয়ে থাকি । কিন্তু চোখের কোণে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখি । মহিলার লম্বা কালো বেণীটা ওর ডান হাতে নিজের থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে । হাতটা ক্রমশঃ আরো লম্বা হচ্ছে, সেটা সে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো । কি একটা অচেনা সরু সরু পাপড়িঅলা সাদাটে ফুল ওর হাতে, সেটা একটু একটু নড়ছে । একটা ভারি গন্ধে কামরাটা ভরে যায় ।
“এই নাও”, সে খুব কোমল গলায় বলে, “তোমার বাবার মাথায় ঠেকিয়ে দিও । ভালো হয়ে যাবেন ।”
আমি সম্মোহিতের মতো হাত বাড়াতে যাই । নিশান আমার হাত চেপে ধরে । “চিত্রা, না ! কি করছো ।”
আমি হাত টেনে নিয়ে নিশানের কাঁধে মুখ গুঁজে চোখ আধো বন্ধ করে রাখি । ট্রেনের গতি বাড়ে । সেই মহিলা কথা বলেই যেতে থাকে, তার গলার সঙ্গে ট্রেনের শব্দ মিলে আমার মাথার ভিতরটা ঝমঝম করে । ট্রেনটা অতর্কিতে একটা টানেলে ঢুকে পড়ে । ভেতরের দেওয়ালে দুধারে লাল নীল সবুজ আলো ঢেউয়ের মতো বয়ে যায় । যেতেই থাকে । তারপর অন্ধকার । শুধু অন্ধকার । মহিলাও চুপ । কতোক্ষণ কাটে ?
ট্রেনটা বেরিয়ে আসে একটা নীলচে কুয়াশার মধ্যে । তারপর থামে । সামনের মহিলা দরজা খুলে নেমে যায় । আমি সোজা হয়ে বসি । এটা...এটা একটা স্টেশন । বেশ বড়ো, শেড দেওয়া, অনেক লোক, তারা সকলে স্হির হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, সামনের দিকে চেয়ে । কুয়াশাটা এখানেও । আর ফেরিওয়ালারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের অনেক রকম পসরা নিয়ে । চা, খাবার, জল, কতো রকমের অদ্ভুত খেলনা, রুমাল, গয়না, খাঁচায় করা পাখি, বাসন, বই....জিনিসগুলো কিরকম যেন....ঠিক স্বাভাবিক নয় । ভালো করে দেখতে গেলেই কেমন বেঁকেচুরে যাচ্ছে । ফেরিওয়ালারা গুনগুন করে কথা বলছে । আমাদের জানলায় এসে কাঁচে টোকা দিচ্ছে ।
নিশান হঠাৎ বলে, “খুব তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু....।”
“না না, জানলা খুলো না ।”
খাঁচায় করে অনেকগুলো পাখি নিয়ে একটা টুপি-পরা লোক আমাদের জানলায় এসে দাঁড়ায় । কাঁচে টোকা দিতেই থাকে । পাখিগুলো ধূসর, লম্বা মতো, খুব তীক্ষ্ণ ঠোঁট, খুব বড়ো বড়ো গোল গোল লাল চোখ । নিশান মাথা নেড়ে না বলে । লোকটা দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন বলতে থাকে । ট্রেনটা ছেড়ে দেয় । লোকটা হঠাৎ খাঁচার দরজা খুলে দেয় আর পাখিগুলো ডানা ঝটপটিয়ে যুক্তিহীনভাবে জানলার কাঁচের মধ্য দিয়ে আমাদের কামরায় ঢুকে উড়ে বেড়াতে থাকে ।
“নিশান !” আমি চেঁচিয়ে উঠি ।
ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে । পাখিগুলো চক্রাকারে উড়তে উড়তে ওদিকের জানলার মধ্য দিয়ে উড়ে বেরিয়ে যায় । আমি বলি, “নিশান, এসব কি হচ্ছে ? এই ট্রেনটা কি ? এই জায়গাগুলো কি ?”
“কি জানি । ওই যে বুড়ো ভদ্রলোক বলেছিলেন না, অনেক কিছু দেখবে, সে সব অগ্রাহ্য কোরো ? “
“অন্য নিয়ম, অন্য জগত...আচ্ছা এই ট্রেনে অন্য যাত্রীরা আছে তো ?”
“আছে, মানে আছে নিশ্চয় । ওঠার সময় আমি লক্ষ্য করি নি ।”
“আমিও না । কেউ নামে নি, আমরা ছাড়া কেউ ওঠে নি । আচ্ছা, আমরা কি স্বপ্ন দেখছি ? সবকিছু কেমন অবাস্তব, না ? বাবা...বাবা কেমন আছেন কে জানে । কতক্ষণ কাটলো, নিশান ?”
“বোঝা যাচ্ছে না । আমার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে । সাতটা কুড়িতে ট্রেনে উঠেছিলাম । এখানে বোধহয় সময়ের কোনো...মাপ নেই ।”
ট্রেনটা আর একটা স্টেশনে থেমে যায় । এটা একটা ছোট স্টেশন । করোগেটের ছাউনি, টিকিট কাটার খুপরি ঘর, যেমন থাকে । ছাদ থেকে আলোর ডুম ঝুলে আছে, সেগুলো দুলছে । অনেকগুলো খয়েরি রঙের বেঞ্চি, সবগুলোতে যারা বসে আছে তারা বোধহয় বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে যাচ্ছে । সকলে খুব সাজগোজ করা । মেয়েদের পরনে দামি শাড়িগয়না । আমাদের জানলার ঠিক সামনেই বর বৌ বসে আছে । বরের মাথায় টোপর, বৌটা সিঁথিমৌর, চন্দন, লাল বেনারসি, গয়না পরে আছে । হঠাৎ চমকে আমি নিশানের কাঁধ আঁকড়ে ধরি ।
“নিশান, দ্যাখো, এরা ওই অসীমবাবুদের বিয়েবাড়ির সবাই না ?”
নিশান ভালো করে দেখে বলে, “হ্যাঁ...ওরাই তো । চিনতে পারছি কয়েকজনকে । ওই তো অসীমবাবু, কোণের দিকে বেঞ্চিটাতে । পাশে ওঁর দাদা । আর ওই ছেলেটা আমাদের স্টেশন থেকে নিতে এসেছিলো । আশ্চর্য, সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কারো কোন প্রতিক্রিয়া নেই, চোখগুলো কেমন শূন্য... ।” নিশানের কণ্ঠ অস্পষ্ট ।
জানলার ঠিক সামনে বসে থাকা কনেবৌটির দিকে তাকাই আমি । ওর নাম মন্দিরা, সবাই মণি বলে ডাকছিলো । ভারি মিষ্টি মেয়ে, নববধূর সাজে খুশিতে ঝলমল করছিলো । ওকে রূপোর ওপর মিনের কাজ করা একটা নেকলেস উপহার দিয়েছিলাম, খুব পছন্দ হয়েছিলো ওর । আর এখন বসে আছে আমার সামনে, আমার দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে । ওর গলায় সেই নেকলেসটা, দুলে যাওয়া আলোছায়ায় চিকচিক করছে । ওর পাশে সেই বাচ্চাটা, ছোটন, যার গলায় খাবার আটকেছিলো, ওর মায়ের কোলে বসে, দুজনের স্হির দৃষ্টি আমার দিকে । মন্দিরা আস্তে আস্তে দুহাত তুলে ওর গলার জুঁইয়ের মালাটা চেপে ধরে, তারপর টুকরো টুকরো করে সেটাকে ছিঁড়তে থাকে, আমার মুখ থেকে ওর দৃষ্টি সরে না । ছেঁড়া ফুলের টুকরোগুলো এলোমেলো হয়ে উড়তে থাকে । আর...
...প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা মানুষদের - ওরা কি মানুষ ? - অবয়বগুলোর প্রান্তরেখা একটু একটু করে ভেঙে গুঁড়িয়ে উড়ে যেতে থাকে । প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ওড়ে গুঁড়োগুলো । একটা তীক্ষ্ণ শিষের মতো শব্দ হয় । ট্রেনটা চলতে শুরু করে ।
ট্রেনের গতি বাড়ে, খুব জোরে দুলতে থাকে । নিশান ভারসাম্য রাখতে কামরার দেওয়ালে একটা হাত রেখেই ভীষণ চমকে যায় । আমায় বলে, “চিত্রা, এটা ছুঁয়ে দেখো ।” আমি সন্তর্পণে সবুজ দেয়ালটায় আঙুল রাখি । সেটা ধাতব নয়, একটু নরম কোনো কিছুতে তৈরি । স্পর্শটা উষ্ণ । শিউরে উঠে হাত সরিয়ে নিই ।
আমি আর নিশান পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরে একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাই । কখনো কি শেষ হবে এই অবাস্তব যাত্রা ? কোথায় যাচ্ছি । কেমন যেন মনে হয় চিরকাল, চিরকাল আমরা এই ট্রেনেই ছিলাম । থাকবো । আমাদের বাস্তব জীবনটাই যেন স্বপ্ন ছিলো । ট্রেনটা থামে, আবার চলে । এমনি ভাবে সময় কাটে....কিংবা কাটে না ।
একটা স্টেশনে আবার দাঁড়ায় ট্রেনটা । আমরা খেয়াল করি কখনো কোনো স্টেশনের কোনো নাম দেখি না । কিংবা হয়তো থাকলেও পড়তে পারি না । এই স্টেশনটা জনশূন্য । কেউ কোথাও নেই । শুধু জানলার সামনের একটা বেঞ্চিতে একটা পাটকিলে রঙের বেড়াল বসে আছে । নীলসবুজ আর হলদেসোনালী, দুরঙের দুটো চোখ মেলে সে আমাদের দেখতে থাকে ।
“নিশান, ওই দ্যাখো ।”
“দেখেছি ।”
আমাদের চমকে দিয়ে পাশ থেকে জানলার সামনে একটা লোক এসে দাঁড়ায় । খুব লম্বা, খুব রোগা, তেকোণা-মতো মুখে চোখের সবজেটে মণিগুলো বিশাল, তার পিছনে যেন ছোট ছোট আলো জ্বলছে । মুখের হাঁ-টা খুব চওড়া, প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে কানের নিচ অবধি ছড়ানো । সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, ধারালো অনেক দাঁত দেখা যায় । আমি ভয়ে নিশানের দিকে সরে আসি । লোকটা মুঠোয় কিছু একটা নিয়ে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কী যেন বলতে থাকে । ট্রেনটা চলতে শুরু করে, লোকটা আমাদের জানলার সঙ্গে এগোতে থাকে । ট্রেনের গতি বাড়ে, সে-ও অনায়াসে সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলে চলে । আতঙ্কে কাঠ হয়ে গিয়ে দেখি, ট্রেনের প্রবল গতি অগ্রাহ্য করে সে জানলার পাশে পাশে হেঁটে চলেছে । আমি আর সহ্য করতে না পেরে নিশানকে জড়িয়ে ধরি, ও বলে ”চোখ বুঁজে থাকো চিত্রা, আর তাকিও না ।আমিও তাই করছি ।”
প্রচণ্ড জোরে চলছে ট্রেনটা । এটা কী আদৌ ট্রেন ! আচ্ছন্নতার মধ্যে হঠাৎ মনে হয়, চারপাশে অনেক লোক । চেঁচামেচি, হট্টগোল, ঠেলাঠেলি...আমার চোখে পাতা খুব ভারি, ভালো করে তুলতে পারি না । কারা যেন ঠেলে জোর করে তুলে দেয় আমাদের । একটা নীল আলো চারপাশে মুহূর্তের জন্য ঝলসে যায় । আমি নিশানের হাত আঁকড়ে থাকি, অন্য হাতটা আমার ব্যাগের স্ট্র্যাপে । মনে হয় পায়ের নিচে একটা অন্য কিছু যেন,....উজ্জ্বল আলো চারদিকে । চোখে ধাঁধাঁ লাগে । লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুজনে । হাওড়া ষ্টেশন । বেশ কিছু যাত্রী বোধহয় বিভিন্ন ট্রেন থেকে নেমে ব্যস্তভাবে এদিক ওদিকে যাচ্ছে । তাদের মধ্যে আমরাও আছি ।
একটা স্যুটকেশ-হাতে লোকের বিরক্ত ধাক্কা সামলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশান বললো, “ঠিক কোনদিক থেকে এলাম আমরা বলো তো চিত্রা ।”
আমি অনিশ্চিতভাবে বললাম, “বুঝতে পারছি না তো !”
দুজনে চোখ তুলতেই ওপরের এক জায়গায় সময়ের ডিসপ্লে দেখলাম । আটটা বাজতে পনেরো । আমরা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে আর কিছু বললাম না । তারপর দুজনের ফোনেই মেসেজ আসার শব্দ হলো । ফোনগুলো সজীব হয়ে উঠেছে ।
বাবা ভালো আছেন, সার্জারির প্রয়োজন হয় নি । বাঁ কাঁধে ও পাঁজরে লেগেছিলো, বাঁ কনুই ভেঙেছে । রাস্তা পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনা । মায়ের সঙ্গে কথাও হলো ।
শুনলাম ওর ফোনে নিশান বোধহয় দাদাকে বলছে, “হ্যাঁ, ওখানে কানেকশান পাওয়া তো....তোমার মেসেজ পাওয়ার পর আর কিছুতেই যোগাযোগ হচ্ছিলো না । আমরা তখন অলরেডি ফেরার ট্রেনে, ....হ্যাঁ, বেশ তাড়াতাড়িই এলাম । আচ্ছা এক্ষুণি আসছি, চিত্রার যা অবস্হা হয়েছিলো...কি বললে ? হ্যাঁ, ভাগ্যিস ট্রেনটা পেয়েছিলাম । আসছি ।”
নিশান আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসলো । আমি ওর হাতটা ধরে রইলাম ।

সমাপ্ত;