The trap of interpretation and analysis in Bengali Spiritual Stories by DR RAJESH CHOUDHURI books and stories PDF | ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ফাঁদ

Featured Books
Categories
Share

ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ফাঁদ

ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ আর টীকাকরনের পাল্লায় পড়ে কত কত মহাপুরুষ আর পুরুষোত্তমের  মূল কথা ও বানীগুলি হারিয়ে গিয়ে বিকৃত অর্থে ছেয়ে গেছে,- তার কোন ইয়ত্তা নেই। গীতার একই শ্লোকের কতরকম ব্যাখ্যা কতজন পন্ডিত করেছেন,- তার হিসেব নেই। প্রত্যেকেই যার যার বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান, পান্ডিত্য দিয়ে গীতার সংস্কৃত শ্লোককে সাধারণ ভক্তদের উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ব্যাখ্যা ও টীকাকরন প্রভাবিত হয়েছে তাদের বৃত্তিরঙ্গীল মন, প্রবৃত্তিগত চাহিদা, বোধের তারতম্য ও ক্ষুদ্র আত্মস্বার্থ দ্বারা৷ শুধু গীতা নয়,- প্রত্যেকটি শাস্ত্রগ্রন্থই এইভাবে যুগ যুগ ধরে ব্যাখ্যা হতে হতে মূল অর্থ ও উদ্দেশ্য হতে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিকৃত বোধ ও ধর্মাচরনের শিকার হচ্ছে।

 শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র তাঁর দেহধারন কালেই নিজ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় তাঁর সমস্ত বানী ও কথাগুলি লিপিবদ্ধ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করে গেছেন। সম্পূর্ন নিজের তত্ত্বাবধানে তিনি এই কাজ করিয়েছেন। 

এক বিশেষ ভক্ত শ্রীশ্রীঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন,-" ঠাকুর,- আমরা দেখেছি পৃথিবীর সকল অবতার ও মহাপুরুষগন দেহরক্ষার পরই তাদের বানী-উপদেশগুলি লিপিবদ্ধ হয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আপনাকে দেখতে পাই,- নিজের জীবনকালেই নিজ উদ্যোগে সমস্ত বানী ও কথাগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশ করাতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন। তার কারন কি ঠাকুর?"

 ভক্তের প্রশ্ন শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর এক শিষ্যকে ডেকে পাঠালেন,- যে একটু আগেই তাঁর সামনে থেকে উঠে চলে গেছে। সে আসতেই,- শ্রীশ্রীঠাকুর তার কাছে জানতে চাইলেন,- একটু আগে সে যখন ঠাকুরের সামনে বসা ছিল তখন ঠাকুর তার পাশের ব্যাক্তির প্রশ্নের উত্তরে কি বলেছেন। 

দেখা গেল,- সেই শিষ্য দাদাটি শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে  অনেকটাই ভুলে গেছেন,  নিজের কিছু কথা যুক্ত করেছেন,- অর্থাৎ হুবুহু কথাটি বলতে সক্ষম হয়নি। মূল কথাটি কিছুটা হারিয়ে গেছে।

 শ্রীশ্রীঠাকুর তখন প্রশ্নকর্তা ভক্ত দাদাটিকে বললেন,- " এই সামান্য একটু সময়ের ব্যাবধানে যদি আমার কথা এমনভাবে বিকৃত হয়ে যেতে পারে,- তবে আমি চলে গেলে আমার কথাগুলির অবিকৃত রূপ কতটুকু বজায় থাকবে,- তা অনুমান করতে অসুবিধা হয়না।"

শ্রীশ্রীঠাকুর চান,- তাঁর প্রতিটি কথা,প্রতিটি বানী অবিকৃতরূপে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছাক। কোনরকম ব্যাখ্যার পাল্লায় পড়ে এই কথাগুলি যেন তার মূল অর্থ ও উদ্দেশ্য থেকে চ্যুত না হয় - তার জন্য তিনি খুব উদগ্রীব ছিলেন। তাই তিনি নিজ উদ্যোগে তাঁর সব বানী ও কথা পুস্তকাকারে প্রকাশ করে গেছেন।

শুধু তাই নয়,- তিনি দিয়ে গেছেন আচার্য্য পরম্পরা। শ্রীশ্রীঠাকুর যার মধ্যে জীবন্ত হয়ে আছেন,- সেই আচার্য্যদেবের উপস্থিতিতে আর তাঁর বানী ও কথার ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রইল না। তিনি সদা সতর্ক দৃষ্টিতে শ্রীশ্রীঠাকুরের কথার মূল অবিকৃত রূপ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।

  যদি আচার্য্যপরম্পরা না থাকত,- তবে এতদিনে শ্রীশ্রীঠাকুরের বানীগুলিও ব্যাখ্যা ও টীকাকরনের ফাঁদে পড়ে হারিয়ে যেত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁর প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য খুঁজেই পেতনা।

 এক বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যাক্তি বলছেন,-" আপনাদের অনুকূল ঠাকুর বেশ লিবারেল। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তিনি এতটা কড়াকড়ি দেখাননি৷ শুধু মাছ-মাংস খেতেই মানা করেছেন। পেঁয়াজ-রসুন, মাদক এইসব নিষেধ করেননি। তাই তাঁর প্রচার এত বেশী, সারা পৃথিবীতে বহু বহু মানুষ তাঁর দীক্ষা নিচ্ছে।"

-" মানে? শ্রীশ্রীঠাকুর কোন জায়গায় বলেছেন,- পেঁয়াজ, রসুন আর মাদক খাওয়া যাবে?" 

-" কেন? আপনাদের ঠাকুরের একটা বইতেই তো পেলাম বানীটা,- 

মাছ-মাংস খাসনে আর,

পেঁয়াজ রসুন মাদক ছাড়।

তিনি তো স্পষ্টতঃ এই বানীতে পেঁয়াজ, রসুন আর মাদক জাতীয় খাদ্যে ছাড় দিয়ে দিলেন। শুধুমাত্র মাছ-মাংস খেতে নিষেধ করেছেন। " ..  এই হল পন্ডিতদের ব্যাখ্যার নমুনা। 

আরো ভয়ংকর নমুনাও আছে। শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি বানী আছে,-

'না' সুন্দরী বধূ যার,

'হয়না' যার শালা,-

অলক্ষী তার ঘরে বসে

সব করে দেয় কালা। 

একজন বিশিষ্ট ভক্তকে কয়েক বছর পূর্বে এক সৎসঙ্গে আলোচনা করতে দেখলাম এই বানীর উপর। বলছেন,-" ঠাকুর কত মূল্যবান একটা কথা বলেছেন!! আমরা আমাদের ঘরের ছেলেদের বিয়েশাদি করানোর সময় টাকার লোভে, -চাকরীওয়ালা মেয়ে পেলেই,- যেমন তেমন চেহারার একটা মেয়েকেই বউ করে আনি। কিন্তু এই বানীতে ঠাকুর স্পষ্ট করে বলছেন, -বউ যদি সুন্দর না হয় তবে সংসার অন্ধকার। কারন,- বউ সুন্দর না হলে ছেলের মন সংসারে টিকবে না। তাই বউ সুন্দর হতে হয়। শুধু তাই নয়। আমরা অনেক সময় সম্পত্তির লোভে বাপ-মায়ের একমাত্র মেয়েকেই পুত্রবধূ করে আনতে পছন্দ করি। তা কখনোই উচিত নয়। ঠাকুর এই বানীতেই বলেছেন,- শালা না থাকলেও সংসার অন্ধকার। কারন তখন নিজের বাপ-মা এবং বউ এর বাপ-মা দুইদিক সামলাতে সামলাতে ছেলের জীবন শেষ!!" 

এইরকম কত কত পন্ডিত ও জ্ঞানীর পাল্লায় পড়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কত কত বানীর দফারফা হয়ে যেত তার ঠিক নেই,- যদি ব্যাখ্যার অনুমতি দেওয়া হত। আচার্য্যদেবের কৃপায় সেই সুযোগটা আর রইল না।

 যারা আরো বুদ্ধিমান ও চালাক,- তারা আরো সূক্ষ্মভাবে এমনতর বিকৃত ব্যাখ্যা করে থাকে যে ভাল ভাল শিক্ষিত মানুষেরাও বেকুব বনে যায়। এবং সেই ভুল ব্যাখ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের বানীর ভুল অর্থ গ্রহন করে সর্বনাশের দিকে এগিয়ে চলে।

 তাই সর্বদাই উচিত সৎসঙ্গ পাব্লিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত শ্রীশ্রীঠাকুরের মূল বানী ও গ্রন্থগুলি নিজে পাঠ করা। নিজে পাঠ করে তার অর্থ অনুধাবন করতে চেষ্টা করা। শ্রীশ্রীঠাকুরের অধিকাংশ বানী ও কথাই সহজ সরল ভাষায় লেখা,- যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে কোন ধরনের অসুবিধা না হয়।

 তা না করে আমি যদি ফেইসবুক, ওয়াটসএপ থেকে ঠাকুরের কথা জানতে চাই, বড় বড় ভক্তদের লেকচার শুনে কেবল ঠাকুরের কথার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ মূখস্ত করতে চেষ্টা করি,- তবে আমার বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই অধিক। অথবা,- ঠাকুরের মূল গ্রন্থগুলি পড়ার আগেই যদি ভক্তদের বিশ্লেষণ মূলক বই পড়ে তাঁকে জানতে চাই তবে আমি ভ্রষ্ট হতে পারি। তাই সাবধান হউয়া ভাল। অন্যের কাছ থেকে শর্টকাট উপায়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কোন কথা, বানী, উপদেশ সম্পর্কে না জেনে,- সবচেয়ে বুদ্ধিমানের উপায় হল নিজেই একটু কষ্ট করে তাঁর লেখা গ্রন্থ পাঠ করে জেনে নেওয়া।

 তাছাড়া,- পরমদয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের জন্য আরেকটি সহজ রাস্তা দিয়ে গেছেন। তাঁর হাজার হাজার বানী রয়েছে মানুষের জন্য। কোন একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়,- তাঁর সবগুলি বানী পড়ে সেগুলির অর্থ অনুধাবন করে নিজের জীবনে চরিতার্থ করা। কয়েক জন্মেও সম্ভব নয়৷ তাই সহজতর উপায় হল,- শ্রীশ্রীঠাকুর যার মধ্যে জীবন্ত হয়ে আছেন, তাঁর সকল বানী যার মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে আছে,- সেই আচার্য্যদেবের উপর সহজ-সরল নির্ভরতা, বিশ্বাস, আনুগত্য নিয়ে তাঁর কথা ও নিদেশগুলি জীবনে মূখ্য করে চলা। তাঁকে তৃপ্ত করতে যতই আমি তৎপর হই,- ততই আমি ঠাকুরের হই। এর চেয়ে সহজ রাস্তা আর নেই।

  শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানতে হলে, তাঁকে নিজের জীবনে অনুধাবন করতে হলে,- সারাক্ষন এত কঠিন কঠিন বানীও তত্ত্বের বিশ্লেষণ, শ্লোক মূখস্ত করার প্রয়োজন পড়েনা। দীক্ষান্তে তিনি যেমনটা বলেছেন তেমনটা সহজ বিশ্বাসে নিষ্ঠার সাথে করে গেলেই তাঁকে নিজের জীবনে অনুধাবন করা যায়। তাঁর দয়া উপলব্দি করা যায়৷ তাঁর অনেক বানীর অর্থই নিজের বোধে সহজভাবে ধরা দেয়। নিজেকে ইষ্টকাজে যতই নিয়োজিত করতে পারি ততই আমি তাঁর হয়ে উঠি। প্রয়োজন শুধু তাঁকে ভালবাসা৷ শ্রীশ্রীঠাকুরের অনেক বড় বড় ভক্ত ছিল যারা লেখাপড়া জানতনা। কিন্তু নিজেদের ভক্তি ও ভালিবাসার জোরে সৎসঙ্গের জগতে দাগ কেটে গেছে। 

আমার প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে যখন ডাক্তারের কাছে যাই,- তখন ডাক্তার যে যে ঔষধ ও ইঞ্জেকশন প্রেসক্রাইব করেন আমি কোনরকম প্রশ্ন, সন্দেহ, অবিশ্বাস না করে তাড়াতাড়ি সেই ঔষধ খাই ও ইঞ্জেকশন লাগাই। আমার পেট ব্যাথা কমে যায়।

 এখন আমি যদি জানতে চেষ্টা করি, - ডাক্তারবাবু যেসকল ঔষধ লিখে দিয়েছেন- সেগুলির mechanism of action কি, সেগুলির উপাদান ও উৎপত্তি কি, কোন ফ্যাক্টরীতে বানানো হয়েছে, সেগুলির Adverse effects কি কি,- তবে আমার পেট ব্যাথা আর কমবে না। সেগুলির উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আমার মৃত্যু ঘটবে।

 শ্রীশ্রীঠাকুরের দীক্ষা গ্রহনান্তে আমাদের চলাও তদ্রুপ হলে ভাল। প্রশ্নহীন আনুগত্য নিয়ে সহজ সরল ভক্তি নিয়ে শুধু করে গেলেই হয়৷ করতে করতেই তাঁর বানী আমার বোধে আসে।