পৌরাণিক টাইম ট্রাভেল
।। যোগী কৃষ্ণদেব নাথ।।
ভারতীয় পুরাণকে আমরা বহুদিন ধরেই গল্পের বই হিসেবে মনে করে এসেছি। অথচ সেই গল্পগুলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন সব ধারণা, যেগুলো আধুনিক বিজ্ঞান আজ নতুন করে আবিষ্কার করছে। রাজা ককুদ্মি ও রেবতীর কাহিনী তার এক অনন্য উদাহরণ; যেখানে সময়ের আপেক্ষিকতা ও ভিন্ন লোকের ভিন্ন কালপ্রবাহের ধারণা স্পষ্টভাবে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
এই কাহিনী প্রধানত বর্ণিত হয়েছে ভাগবত পুরাণের নবম স্কন্ধ, তৃতীয় অধ্যায়ে। সংক্ষিপ্ত রূপে উল্লেখ রয়েছে বিষ্ণু পুরাণের চতুর্থ অংশেও। ভাগবত পুরাণের বর্ণনাই সবচেয়ে পরিপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।
রাজা ককুদ্মি ছিলেন প্রাচীন যুগের এক শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাবান রাজা। তাঁর কন্যা রেবতী রূপে, গুণে ও বিদ্যায় অতুলনীয়। কিন্তু সেই গুণের কারণেই সমস্যা। ককুদ্মি যখন পৃথিবীতে রেবতীর জন্য উপযুক্ত বর খুঁজতে গেলেন, তখন দেখলেন -- যাদের তিনি যোগ্য মনে করেন, তাঁরা হয় রেবতীর তুলনায় অনেক কম যোগ্য, নয়তো যুগের দিক থেকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এই দ্বিধা মেটাতে তিনি সরাসরি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
রেবতীকে সঙ্গে নিয়ে ককুদ্মি গেলেন ব্রহ্মলোকে।
ভাগবত পুরাণ জানায়, ব্রহ্মা তখন গন্ধর্বদের সঙ্গীত শ্রবণে নিমগ্ন ছিলেন। ককুদ্মিকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। এই অপেক্ষা ব্রহ্মলোকে দীর্ঘ ছিল না; কয়েক মুহূর্ত মাত্র ছিল। কিন্তু সেই কয়েক মুহূর্তই পৃথিবীর হিসেবে ভিন্ন অর্থ বহন করছিল।
যখন ব্রহ্মা ককুদ্মির কথা শোনেন, তখন রাজা একে একে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজাদের নাম উচ্চারণ করেন; যাদের তিনি রেবতীর জন্য উপযুক্ত ভেবেছিলেন। ব্রহ্মা তখন মৃদু হেসে বললেন, ওই সকল রাজারা বহু আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বহু যুগ পার হয়ে গেছে। এখন অন্য যুগ চলছে, অন্য মানুষের সময় চলছে।
এরপর ককুদ্মি ও রেবতী যখন পৃথিবীতে ফিরে আসেন, তখন তারা দেখতে পান, পৃথিবী সম্পূর্ণই বদলে গেছে। মানুষের আকার ও প্রকৃতিও বদলে গেছে। সমাজ, রীতি, যুগ সবই পাল্টে গেছে। যে সময় ককুদ্মির কাছে ছিল ব্রহ্মলোকে কয়েক মুহূর্ত, পৃথিবীতে তা হয়ে উঠেছে সহস্র সহস্র বছর।
এই কাহিনী কি নিছক একটি কল্পনা ?
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান আজ যে ধারণাকে বলে টাইম ডাইলেশন -- অর্থাৎ সময় সর্বত্র সমান গতিতে প্রবাহিত হয় না; এই কাহিনির সঙ্গে তার বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বলে, গতি ও মহাকর্ষের পার্থক্যে সময়ের গতি বদলে যায়। এক স্থানে যা কয়েক মিনিট, অন্য স্থানে তা হতে পারে বহু বছর। পুরাণের ভাষায় বলতে গেলে ব্রহ্মলোকের এক মুহূর্ত = পৃথিবীর বহু যুগ। এটাই তো সময়ের আপেক্ষিকতা।
ভারতীয় দর্শনে "লোক" মানে কেবল ভৌগোলিক স্থান নয়। লোক মানে অস্তিত্বের স্তর, চেতনার স্তর, এবং সেই সঙ্গে সময়ের স্তর। ভূলোক, স্বর্গলোক, ব্রহ্মলোক -- এগুলোকে যদি আধুনিক ভাষায় বলি, তবে এগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্পেস-টাইম ফ্রেম হিসেবেই বোঝা যায়।
রেবতীর বিবাহ শেষে হয় বলরামের সঙ্গে; যিনি পূর্বযুগের প্রতিনিধি। এই নির্বাচনও প্রতীকী। যুগ বদলালেও, সময়ের সেতু রচনা করতে পারে এমন সত্তাই প্রকৃত সামঞ্জস্য রক্ষা করতে সক্ষম।
এই কাহিনির মূল প্রণিধানযোগ্য বিষয় রেবতীর বিয়ে নয়। এর আসল শিক্ষা হলো সময় আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান আজ যাকে বলে টাইম ট্রাভেল, ভারতীয় পুরাণ তা গল্পের ছলে রেখে গেছে; তত্ত্বের ভাষায় নয়, উপলব্ধির ভাষায়। কারণ এই জ্ঞান বোঝার জন্য শুধু মস্তিষ্ক নয়, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার।
সমস্যা হলো আমরা পুরাণকে পড়েছি বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের চোখে, কিন্তু জ্ঞানচর্চার চোখে পড়িনি। রাজা ককুদ্মির ব্রহ্মলোকে যাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ যত আধুনিকই হোক, সময়ের কাছে সে আজও শিক্ষার্থী। আর ভারতীয় জ্ঞানধারা, হাজার হাজার বছর আগেই, সময়ের রহস্যকে স্পর্শ করেছিল; কোনো গণিতের সূত্রে নয়, চেতনার গভীর উপলব্ধিতে। এই উপলব্ধিটাই আজ সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।