ছোট শহরে, ছোট গ্রামে বাস করলে বা ছোট স্কুলে পড়াশোনা করলে কিছু লাভ আছে,- কিছু ক্ষতি আছে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন,- বিশ্বের অধিকাংশ নেতা, অধিকাংশ বিখ্যাত ব্যাক্তিরা ছোট্ট গ্রাম, ছোট্ট শহর, ছোট্ট অখ্যাত স্কুল থেকে উঠে এসেছেন। তার পেছনে কারন হল,- বড় শহরে অনেক গুনী মানুষ থাকেন, বহু প্রতিভার সমাবেশ সেখানে, বহু নেতার ভীড়। সেই ভীড়ের মাঝে নিজেকে বিশেষভাবে মেলে ধরা, নিজের নেতৃত্ব ও পরিচালনার গুনের সাথে পরিচিত হওয়া বা আত্মপ্রত্যয় গড়ে উঠা কঠিন। ছোট্ট গ্রামে বা ছোট্ট শহরে অল্প লোকের মাঝখানে অল্প বয়স থেকেই নিজের নেতৃত্ব, নিজের দক্ষতা সহজে গড়ে উঠে। সেখানে প্রতিযোগিতা কম, - তাই প্রথম হওয়া সহজ। তাই সহজেই আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় গড়ে উঠে,- যা পরবর্তী জীবনে নিজেকে মেলে ধরতে অনেক সহায়ক হয়।
ছোট স্কুলেও একই ব্যাপার ঘটে। সেখানে নিজের সামান্য মেধার জোরে প্রথম হওয়া যায়,- নিজেকে ছোটবেলা থেকেই বিশেষ একজন মানুষ বলে জানা যায়,- তাতে ব্যাক্তিত্ব গড়ে উঠে। এই ব্যাক্তিত্বই পরবর্তী জীবনে নিজেকে সুউচ্চ স্থানে নিয়ে যায়।
সেই একই মানুষটি যদি বড় শহরে, বড় স্কুলে তার শৈশব কাটাত তবে হয়ত অনেক প্রতিভার ভীড়ে হীনমন্যতায় ভুগত,- বা নিজেকে সাধারণ আটদশটা মানুষের মতই ভাবতে শিখত। তাতে উপযুক্ত ব্যাক্তিত্ব গড়ে উঠার সুযোগ কমে যেত।
আমিও আমার গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবসময় প্রথম স্থান দখল করতাম। ফলে নিজের মনেই একটা বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল,- I am the best!! আমার চেয়ে অধিক মেধাবী, অধিক প্রতিভাবান আর কেউ হতে পারেনা।
একবার তৃতীয় শ্রেনীর বার্ষিক পরীক্ষায় অংকে আমার চেয়ে বেশী পেয়েছিল আমার এক বন্ধু। যদিও আমি ক্লাসে প্রথম হয়েছিলাম,- কিন্তু অংকে সে কেন আমার চেয়ে বেশী পেয়ে গেছে,- আমি কেন পারলাম না,- এই নিয়ে কান্নাকাটি করছিলাম।
আত্মপ্রত্যয় ভাল ব্যাপার,- কিন্তু আত্ম অহংকার বিপজ্জনক। এটাই সাইড এফেক্ট!! ছোট গ্রামে, ছোট শহরে বা ছোট্ট স্কুলে একটু প্রতিভাবান হলেই আত্ম অহংকার কঠিন হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আমার মনেও বেশ কঠিন একটা অহংকার জন্ম নিয়েছিল।
সেই অহংকারে তীব্র আঘাত লাগল যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেনীতে উঠে আগরতলার বিখ্যাত স্কুল,- উমাকান্ত একাডেমিতে ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম,- আমি Best নই। আমার চেয়ে অনেক মেধাবী, অনেক প্রতিভাবান ছাত্র আমার ক্লাসে রয়েছে। নিজের লেভেল বুঝতে পারলাম। প্রথম স্থান দখল করা দূরস্ত,- অনেক চেষ্টা করে কোনরকমে তৃতীয় স্থান দখল করেও পরেরবার আর ধরে রাখতে পারিনি৷
যাই হোক,- পড়াশোনার জগতে যত অগ্রসর হয়েছি,- ততই বুঝতে পেরেছি,- আমি খুব সাধারণ মানের একজন ছাত্র। খারাপ নই,- কিন্তু খুব ভাল নই। তাতে আমার কঠিন অহং বিগলিত হয়েছে।
ঠাকুরের জগতেও একই ব্যাপার ঘটে। দীক্ষা নিয়ে খুব ঠাকুর ঠাকুর করছি, অনেক যাজন করছি, ডিপি ওয়ার্ক করছি, ঘনঘন দেওঘর যাচ্ছি, ভাষন দিচ্ছি, গান গাচ্ছি, খুব লেখালেখি করছি,- সব্বাই খুব প্রশংসা করছে, সম্মান দিচ্ছে। তখন মনে হয়,- বা: আমি তো বেশ বড় ভক্ত হলাম!! নিজেকে বিশেষ ভক্ত মনে হতে শুরু করল,- অজান্তেই ভক্তির অহংকার জমাট বাঁধতে শুরু করল।
আর,- তখনই ঠাকুর এমন কিছু পরিস্থিতিতে ফেলেন, এমন কিছু মানুষের সম্মুখে নিয়ে আসেন,- নিজের অহংকার ভেঙে যায়। বুঝতে পারি,- আমি সাধনজগতে এখনো শিশু,- ভক্তির পথে আমি এখনো হামাগুড়ি দিচ্ছি। এটাই ঠাকুরের দয়া।
আট দশ বছর আগের কথা। সহ: প্রতিঋত্ত্বিকের পাঞ্জা প্রাপ্ত হয়েছি কিছু মাস হল৷ তখন আমি শ্রীশ্রীদাদার নির্দেশে হাজার দীক্ষার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছি।
ত্রিপুরার এক প্রত্যন্ত জনজাতি এলাকায় তিন চারজন বয়স্কা জনজাতি মা আমাকে নিয়ে ঘরে ঘরে যাচ্ছেন,- যাজন ও দীক্ষা হচ্ছে৷ আমি কথায় কথায় মা'দেরকে জিজ্ঞেস করলাম,-" আপনারা দেওঘর ঠাকুরবাড়ি গিয়েছেন?"
-" হ্যা দাদা, বছর তিনেক আগে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম। "
-" বাঃ খুব ভাল।"
মা তিনজন তাদের দেওঘর যাত্রার গল্প বলতে লাগল। বলছেন,-" আমরা তো প্রথমবার গিয়েছি দেওঘর,- কিছুই চিনিনা কোথায় কি আছে, কে কোথায় বসেন। দেখলাম,- একটা নাটমন্ডপে আচার্য্যদেব বসেন রোজ। আমরা সকাল সন্ধ্যা উনার সামনেই শুধু বসে থাকি।
এইভাবে তিনদিন কেটে গেল,- আমাদের চলে আসার সময় হয়ে গেল। শেষের দিন আচার্য্যদেবের সামনে বসে বসে আমরা ভাবছি,- আবার কবে আসব দেওঘর তা ঠিক নেই। এত পয়সা খরচ করে আমাদের পক্ষে তো ঘন ঘন আসা সম্ভব নয়। জীবনে প্রথমবার আসলাম,- যদি আচার্য্যদেবকে কোন ভাবে একটু সেবা দেওয়ার সুযোগ পেতাম। এই নাটমন্ডপটা যদি আমরা একটু ধুয়েমুছে পরিস্কার করে দেওয়ার সুযোগ পেতাম,- আমাদের জীবন ধন্য হত। আমরা তিনজন নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে কথা বলছিলাম,- আর খুব প্রার্থনা করছিলাম ঠাকুরের কাছে এই সুযোগটুকু দেওয়ার জন্য।
একটুপর আচার্য্যদেব উঠে চলে গেলেন,- সবাই চলে গেল ধীরে ধীরে। জায়গাটা খালি হয়ে গেল। আমরা তিনজন সেখানেই বসে আছি।
একটু পর একজন ঋত্ত্বিকদাদা এসে আমাদের বলছেন,- আপনারা তিনজন তো অবসর বসে আছেন। এই নাটমন্ডপটা একটু ধুয়ে পরিস্কার করে দেবেন?
আমরা খুব আনন্দিত হলাম। বুঝলাম,- ঠাকুর আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন।
আমরা তিনজন মিলে অনেকক্ষন ধরে নাটমন্ডপটা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিলাম। কি যে শান্তি পেলাম,- দাদা। ঠাকুরের কি দয়া আমাদের উপর।"
...আমি অবাক হয়ে মা তিনজনের গল্প শুনছিলাম,- আর নিজের কথা ভাবছিলাম। দেওঘর তো কতবার গিয়েছি,- কিন্তু কখনো এই মা তিনটির মত আচার্য্যদেবকে সেবা দেওয়ার জন্য তো আকুল হই নি!!বরং অনেকের মত আমারও একটা প্রবনতা থাকে,- এত কষ্ট করে যখন দেওঘর এসেছি,- আচার্য্যদেবের কাছে কিছু একটা নিবেদন করতেই হবে। কিছু একটা প্রাপ্তি নিয়ে যেতেই হবে। ছেলের চাকরি, মেয়ের বিয়ে, বউএর কোমড় ব্যাথা, মায়ের প্রেসার, আমার প্রমোশন, - একটা না একটা নিবেদন না করলে যেন মনে শান্তিই পাইনা। মনে হয় দেওঘর আসাটাই বৃথা। নিবেদন করে বাড়ী গিয়ে সবার কাছে যদি গল্পই না করতে পারি,- আচার্য্যদেব আমার নিবেদন শুনে কি বললেন, তিনি আমায় কি আশীর্বাদ দিলেন,- তবে এত কষ্ট করে আসাটাই বৃথা মনে হয়। কখনো অমন করে সেবা দেওয়ার প্রবৃত্তি তো হয়নি আমার।
কিন্তু ঐ মা তিনটি নিজের জন্য কিছুই চায়নি, কিছুই নিবেদন করেনি। আচার্য্যদেবকে সেবা দেওয়াতেই শুধু আনন্দ তাদের।
এই মা তিনটির দেওঘর যাত্রার গল্প আমার সারাজীবন মনে থাকবে। আমি যদি এই মা তিনজনের মত সহজ ভক্তির অধিকারী হতে পারতাম, যদি তাদের মত আচার্য্যদেবকে ভালবাসতে পারতাম। দয়াল ঠাকুর দয়া করে এই মা তিনজনের সঙ্গ করার সুযোগ আমায় দিয়েছেন,- এটা আমার জীবনে পরম প্রাপ্তি।
কিছুদিন আগে আসন্ন দেবদীপনী উৎসবের নিমন্ত্রনে ঘরে ঘরে যাচ্ছি। আমি, শ্রদ্ধেয় স্বপনদা, ইষ্টরঞ্জন ভাই,- সাথে একটি নতুন গুরুভাই। তার বয়স পনের,- ক্লাস নাইনে পড়ে।
তার সংসারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। মা বাসা বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। ছেলেটি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে দিনমজুরের কাজ করে সংসারে জোগান দেয়।
সে আমাদের সাথে রোজ উৎসবের নিমন্ত্রনে বেরুচ্ছে। শ্রদ্ধেয় স্বপনদা তাকে জিজ্ঞেস করলেন,-" তুই কি দিবি উৎসবে?"
সে একটু ভেবে বলল,- "আমি একদিন মজুরির কাজ করলে পাঁচশ টাকা পাই। দশদিন কাজ করে পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে আমি উৎসবে অর্ঘ্য দেব। "
সে জানাল,- ইতিমধ্যে সে আড়াই হাজার টাকা সঞ্চয় করে ফেলেছে উৎসবের অর্ঘ্য দেবে বলে। আমি অবাক শ্রদ্ধায় তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আরেক গুরুভাই,- প্রাইভেট টিউশন করে। মাসিক রোজগার আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক কম। খুব সামান্য রোজগারে কষ্টেসৃষ্টে চলছে তার দিন। বেশ কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাচ্ছে। তার বাড়িতে সেদিন সকালে গেলাম। আমরা আশা করছিলাম,- হয়ত দুই তিন হাজার টাকা অর্ঘ্য চাওয়া যেতে পারে। আমি আর স্বপনটা তার কাছে এই পরিমান অর্ঘ্য চাইতে ইতস্তত করছিলাম,- সে এতটা পারবেনা ভেবে। স্বপনদা অর্ঘ্য সংগ্রহের খাতাটা তার হাতে দিয়ে বললেন,-" তুই নিজে থেকে তোর অর্ঘ্যের পরিমানটা লিখে স্বাক্ষর কর।" সে খাতায় লিখল,- কুড়ি হাজার টাকা। আমরা দুইজনেই অন্তত অবাক হলাম।
তাদেরকে দেখে,- আমি শিখছি। সামর্থের বাইরে গিয়েও ঠাকুরকে কিভাবে দিতে হয়,- তার এক বাস্তব দৃষ্টান্ত আমি পেলাম। এমন কত ভক্ত তথা ঠাকুরের মানুষ রয়েছে। আমি নিজে কত কম অর্ঘ্য দেই ঠাকুরের বিভিন্ন কাজে,- তা আজ অন্তরে অন্তরে অনুভব করলাম।
বুঝতে পারলাম,- সাধনা মানেই হচ্ছে সাধ্যকে অতিক্রম করে করা। আমি রোজ বিশ কিলো ওজনের ডাম্বেল নিয়ে ব্যায়াম করি,- তাতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যদি ব্যায়ামের সুফল পেতে হয় তবে আগামীকাল থেকে আমায় পচিঁশ কিলো ওজনের ডাম্বেল নিয়ে ব্যায়াম করতে হবে। ঠাকুরের কাজে অর্ঘ্য দিচ্ছি,- কিন্তু তাতে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা,- তাহলে তা সাধনা হলনা। অর্ঘ্য দিয়ে যদি আমার সংসারে একটু টানাটানি শুরু না হল, কয়েকমাস পনীর কিনতে না পেরে যদি আমার আলুসিদ্ধ ভাত খেয়ে থাকতে না হয়,- তবে তা আমার সাধনা হলনা।
আমার মাসিক রোজগার কত টাকা,- বা আমার ব্যাংকে কত টাকা আছে,- তার উপর অর্ঘ্যের পরিমান নির্ভর করেনা। আমি কতটুকু নিজেকে নিংড়ে দিতে চাই ঠাকুরের পায়ে, আমার মনের আকুলতা কত বেশী,- সেটার উপরই নির্ভর করে।
ঠাকুরের কাজে বেরিয়ে এই লাভটুকু হচ্ছে আমার। ঠাকুর দয়া করে তাঁর এমন ভক্তদের সঙ্গ করার সুযোগ দিচ্ছেন, তাঁর প্রকৃত ভক্তদের সামনে দাড়া করিয়ে আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন,- আমার সাধনা আরো কত বাকী। আমার অহংবোধ দূর করে দিচ্ছেন তিনি। " আমি অনেক ঠাকুরের কাজ করি, আমি ঠাকুরকে অনেক দেই"- এই বোধও আমাদের মনে কখনো কখনো কঠিন অহংকার জন্ম দেয়। তিনি দয়া করে প্রতিনিয়ত এই অহংবোধ কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমি নিজের ভক্তি ও সাধনার ক্ষুদ্রতা অনুভব করি প্রতিনিয়ত।