A sky and many rains books and stories free download online pdf in Bengali

একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি

একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি

শফিকুল ইসলাম

আমীর প্রকাশন

প্রারম্ভিক কথা...

জীবন এক উত্তাল সমুদ্দুর,

সেই সমুদ্দুরে ভাসতে ভাসতে

আশা নিরাশা ও স্বপ্ন দোলায় দুলতে দুলতে

মানুষ তীর ছুতে চায়,

তবু পৌঁছুতে পারে কি....

আশাই জীবন।

এই অনিশ্চিত যাত্রায় ও

স্বপ্ন থেমে থাকে থাকেনা,

থেমে থাকে না জীবন।

এই তরঙ্গ-সংকুল জীবনে

একটি মানবীর মুখ

উষ্ণ সান্নিধ্যের প্রত্যাশা

মানুষকে ব্যাকুল করে,

সেই ব্যাকুল প্রত্যাশা ও ব্যর্থ হয়ে যায়

এক সময়

নিষ্ঠুর নিয়তির ক্ষমাহীনতায়।

জীবন তাকে ছুটি না দিলেও

সবার অলক্ষ্যে

সংসার বন্ধন থেকে মুক্তির ছাড়পত্র

কখন এসে পৌঁছে যায়,

কেউ জানতে পারে না ॥

উৎসর্গ

যাদের গভীর আস্থা আছে আজ ও

মানুষের প্রতি-

এখন ও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা।

***

একদিন আমি ছুটি নিয়ে

একদিন আমি ছুটি নিয়ে

সত্যি সত্যি চলে যাবো চিরতরে,

আর ফিরে আসবো না কোনদিন।

তোমরা ভাববে ভাবুক ছেলে

এই চলে যাচ্ছি বলে কতবারই তো যেতে গিয়ে

ফিরে ফিরে চলে এসেছে...

এই তো দুদিন তিনদিন পর,

না হয় বড়জোর তার পরদিন

ঘরের ছেলে ঠিকই ঘরে ফিরে আসবে।

কিন্তু, না- এবারই প্রথম

একদিন যাবে আমি আসবো না,

দুদিন যাবে আমি আসবো না,

সপ্তাহ গড়াবে আমার তবু দেখা নেই...

তারপর এমনি করে মাস বছর যখন গড়াবে,

তোমরা তখন সত্যি সত্যি ভাবনায় পড়ে যাবে-

তাহলে কি যাই বলে

ছেলেটা কি সত্যি সত্যি সকলকে ফাঁকি দিয়ে

একেবারেই চলে গেল!

সত্যি সত্যি

তোমরা যখন আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করবে,

তখন আমি আসলেই চলে গেছি

সব ভাবনার ওপারে-

তোমরা জানবে

একদিন ছুটি নিতে গিয়ে

আমি অনন্ত ছুটি পেয়ে গেছি এ সংসার থেকে ॥

একদিন স্বপ্ন ছিল

একদিন স্বপ্ন ছিল

ভোরের বিশুদ্ধ বাতাসে বুক ভরে

একবার একবুক নিঃশ্বাস নেবো।

একদিন স্বপ্ন ছিল দুচোখ মেলে

প্রাণ ভরে দেখবো একটি রক্তিম সূর্যোদয়।

দূর পাহাড়ের চূড়ায়

একদিন স্বপ্ন ছিল

উড়াবো আমার মনের বিজয় পতাকা।

অথৈ সাগরে নোঙর ছেড়ে

মুক্ত নাবিকের মত

খেয়াল খুশির হাওয়ায় ভেসে

যেদিক খুশি সেদিক ভেসে বেড়াবো।

একদিন স্বপ্ন ছিল

উড়ন্ত পাখির ডানায়

আমার নীলখামে ভরা একটি চিঠি

পাঠিয়ে দেবো তার ঠিকানায়।

একদিন স্বপ্ন ছিল

মুক্ত আকাশের নীচে

ভালবাসার সবুজ চত্বরে

তার কোলে মাথা রেখে

জীবন থেকে চিরবিদায় নেবো ॥

এই ছোট্ট জীবনে

এই ছোট্ট জীবনে

অমিতব্যয়ীর মত তোমার পেছনে

জীবনের সমস্ত সময় ব্যয় করে

আজ সম্মুখে তাকিয়ে দেখি

তুমি নেই।

আমার সামনে শুধু ধু ধু শূন্যতা,

আর খাঁ খাঁ করা বিস্তীর্ণ প্রান্তর

আর কেউ নেই, কিছু নেই।

মায়ামৃগের মত তুমি ক্রমশ

দূর হতে আরো দূরে চলে গেছ

খেলা শেষের বেলায়।

আজ না-পাওয়ার বেদনাকেই

সাথী করে ঘরে ফেরা

বুকের ভেতর নীরব হাহাকারকে

সঙ্গী করে ॥

এই জীবনে আমার

এই জীবনে আমার

যত অপূর্ণতা আর যত দীনতা

তোমার মাঝে এসে পূর্ণতা খুঁজে পায়-

দীনতার মাঝে ও খুঁজে পায়

ঐশ্বর্যের মহিমা।

আমার বিশাল বিজয়

বিপুল অর্জন-

পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কাঁদে

তোমার স্বীকৃতিবিহীন|

আমার সব সফলতা

বিফলতার বেদনা নিয়ে কাঁদে

তোমার অস্বীকৃতিতে|

তোমার দুবাহু যখন মালা হয়ে

আমার কন্ঠ নিবিড় অনুরাগে জড়িয়ে রাখে,

তখন মনে হয় এর চেয়ে

শ্রেষ্ঠ বিজয়মাল্য আমার আর নেই।

শত বিজয় উল্লাস করতালি ছাপিয়ে

যখন দেখি গোলাপ পাপড়ির মত

তোমার রাঙা ঠোঁটে বাঁকা হাসি-

তখন মনে হয়

আমার জীবনে এই তো শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি Ñ

আমার জীবনে এর চেয়ে বড়

গৌরবময় মানপত্র আর নেই ॥

কেন তোমার কথা ভাবলে

কেন তোমার কথা ভাবলে

হৃদয় হুহু শূন্যতায় হাহাকার করে উঠে-

চোখের কোণ মুহূর্তে

ভেঁজা স্যাতস্যাতে হয়ে যায়?

পরিপার্শ্ব কেমন বিষণ্ন বেদনা-বিধুর বলে মনে হয়-

তুমি বলে দাও।

তুমি চলে গেলে

কেন অন্তরে বাঁজে তোমায় হারাবার

অফুরন্ত বেদনাবোধ,

সুর-মূর্ছিত বীণা-ঝংকার

মুহূর্তে অবাঞ্চিত শব্দের

অসহ্য কোলাহল বলে মনে হয়।

তোমাকে হারিয়ে

হৃদয় কেন সব হারানোর

অপূরণীয় ক্ষতির বেদনাবোধ নিয়ে কাঁদে

তুমি বলে দাও ॥

তুমি চলে গেছ

তুমি চলে গেছ-

আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে আজ

শোক উদযাপনের মহড়া।

তুমি চলে গেছ-

তাই জীবনে যতদিন বেঁচে থাকবো

জীবনের বাকী দিনগুলি

প্রতিটি দিন শোক দিবস হয়ে

আমার কাছে ধরা দেবে।

তুমি চলে গেছ-

আমার জীবনটাই তো আজ

একটি অনন্ত শোকসঙ্গীত হয়ে গেছে।

তোমার বিচ্ছেদে-

দেশ কাল অতিক্রম করে

শোক পালন করলে ও জানি

আমার প্রকৃত শোক প্রদর্শন হবে না।

তুমি চলে গেছ-

তাই আমি সমস্ত পৃথিবীব্যাপী

শোক পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।

তুমি চলে গেছ-

অনন্তকাল ধরে আমি

শোক দিবস পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।

তুমি চলে গেছ-

আমার কবিতা তাই অসমাপ্ত রেখে

আমি শোক মিছিলে চলে এসেছি।

আমার অসমাপ্ত কবিতাই

স্মরণ করিয়ে দেবে

তুমি ছিলে এই হৃদয়ের কতটুকু-

আমার অসমাপ্ত পংক্তিমালাই

স্মরণ করিয়ে দেবে

তোমাকে ছাড়া এই জীবন কত অসম্পূর্ণ ॥

সারাদিন পড়ে থাকি

সারাদিন পড়ে থাকি

আশাহীন আনন্দহীন একা ঘরে।

উৎসবহীন এই জীবন

বড় বেশী নিশ্চুপ, নিস্তরঙ্গ

আনন্দ কোলাহলে মুখরিত হয় না

আমার বিজন ঘর কখন ও।

তবু ও তুমি যখন মনের খেয়ালে

কখনও এ ঘরে পা রাখো-

আমার উৎসবহীন শূন্য ঘর

মুহূর্তে অজানা উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে-

অজানা সৌরভে আমোদিত হয় ;

দীপ-না-জ্বালা অন্ধকার ঘর

এক অলৌকিক অদৃশ্য আভায়

মুহূর্তে আলোকিত হয়ে উঠে।

তুমি চলে গেলে নিমেষে সবই অন্ধকার,

বিষণ্ন শূন্যতা গ্রাস করে চারিধার-

আর আমি কাঙালের মত

তোমার পুনরাগমনের অপেক্ষায়

উন্মুখ হয়ে থাকি।

ওগো বন্ধু আমার এ ঘর কবে

তোমার ঘর হবে?

আর কবে আমি তোমার সে ঘরে

অতিথি হয়ে কাটিয়ে দেবো

বাকিটা জীবন-

তোমার আঁচলের ছায়া তলে ॥

আর সবাই যখন ব্যস্ত

আর সবাই যখন ব্যস্ত

প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে

রাজক্ষমতা হস্তগত করতে-

অধিকৃত ভূমিতে

আপন নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়-

কিংবা শ্রমিকের ঘাম-ঝরানো

শ্রম শোষণের মাধ্যমে

সম্পদের পাহাড় গড়তে ব্যস্ত-

আর ব্যস্ত মানুষ হয়ে মানুষের উপর

প্রভুত্ব বিস্তার করতে-

কিংবা ভাড়াটে স্তাবক কর্তৃক রচিত

স্তোত্র শ্রবণে ব্যস্ত-

আমি তখন নীরবে নিভৃতে সকলের অজ্ঞাতসারে

আর একটি কবিতার খসড়া বিনির্মাণ করি।

আমি তখন সকলের অলক্ষ্যে পুষ্পিত উদ্যানে

সদ্য প্রস্ফোটন্মুখ আর একটি পুষ্পের

প্রস্ফুটন প্রত্যক্ষ করি।

প্রিয় নারীর রাঙা-ঔষ্ঠে

আর একটি মধু-চুম্বন এঁকে দেবার

শেষ প্রস্তুতি সম্পন্ন করি।

চেতনার মরুদ্যানে আর একটি পুষ্প বিকাশের

অনুকূল পরিবেশ রচনা করি ॥

তুমি আমার সমৃদ্ধ অতীত

তুমি আমার সমৃদ্ধ অতীত,

চলমান বর্তমান,

সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ

তোমাকে বাদ দিলে আমার আর থাকে কি?

তোমার চোখে চোখ রেখে

আমি আমার বিশ্ব পৃথিবী দেখি।

তোমার ভালবাসা আমার প্রেরণা,

তুমিই আমার স্মৃতি-

রাতের স্বপন, দিবসের কল্পনা-

তোমাকে বাদ দিলে আমার আর থাকে কি?

স্মৃতি বলে আর কিছু থাকে কি?

তোমাকে বাদ দিলে

আমি স্মৃতি-ভ্রষ্ট মানুষ হয়ে যাই।

আমার বলার যদি কিছু থাকে

সে তোমার কথা-

আমার চাওয়ার যদি কিছু থাকে

সে তুমি-

তুমি ছাড়া আমার কিছু চাওয়া নেই

পাওয়ার কিছু নেই-

তোমাকে বাদ দিলে আমার আর থাকে কি?

তোমাকে দিয়েছি

তোমাকে দিয়েছি

আমার সকাল, উদাস দুপুর, বিষণ্ন সন্ধ্যা,

নিঝুম রাত

বল আর ও কি তুমি চাও?

তোমাকে দিয়েছি আমার খেলা ঘর,

আমার বাঁশি,

তোমাকে দিয়েছি আমার মন,

বল আর ও কি তুমি চাও?

তুমি আমার ভাবনার খেই কেড়ে নিয়েছ-

তুমি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছ-

বল আর ও কি তুমি চাও?

তুমি আমার স্বপ্ন জুড়ে আছো,

তুমি আমার হৃদয় জুড়ে বসেছ

তুমি আমার ভূবন জুড়ে আছো-

বল আর ও কি তুমি চাও?

আসলে যার আসার কথা

আসলে যার আসার কথা সেই আসে না,

অনেকেই আসে, অনেকেই যায়

অনেকের-ই ঘর-উপচানো আগমনে

ঘর ভরে যায়।

এ মন তবু একজনের বিরহে

খা খা শূন্য রয়ে যায়।

হঠাৎ দূর অজানা থেকে

এক ঝাঁক পাখি এসে

আমার সাজানো বাগান ছেয়ে ফেলে

তাদের বাহারী বর্ণে, বিচিত্র শব্দে-

শুধু একটি ছোট্ট প্রিয় একটি পাখির

সুমধুর সংগীতের অভাবে

সব কলকাকলী অসহ্য কোলাহল

বলে মনে হয়।

আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ হাসে

বিকশিত প্রতিটি পুষ্পে ছড়ানো পুষ্পিত হাসি-

তবু একটি মায়াভরা মধু মুখে

মিষ্টি একটু হাসির আভা নেই বলে

সমস্ত পৃথিবী বিষণ্ন বলে মনে হয়।

কেবল একজন পাশে নেই বলে-

এত বিপুল ভীড়ে এত লোকারণ্যের মাঝে

নিজেকে বড় অসহায় একাকী বলে মনে হয় ॥

শুধু তুমি কাছে নেই বলে

শুধু তুমি কাছে নেই বলে

কত জোছনামাখা মায়াবী রাত

আমি অনাদরে ফিরিয়ে দিয়েছি,

আর কত শিশির-ভেজা শিউলিঝরা ভোর

আমি অবহেলাভরে ফিরিয়ে দিয়েছি।

তুমি কাছে নেই বলে

পলাশ বকুলের সমারোহে সাজানো

কত বসন্ত আমি ফিরিয়ে দিয়েছি

আমার তপ্ত নয়নের জলে।

তুমি কাছে নেই বলে

নিজেই নিজের হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করেছি

আত্মঘাতী সহিংস আঁচড়ে-

আর নিজের ক্ষতঝরা রক্তের অক্ষরে

নিজের হৃৎপিন্ডে লিখেছি

একটি অমোঘ নাম হৃদয়ের বর্ণমালায়-

সে তো তোমারই নাম ॥

প্রতীক্ষায় ছিলাম

প্রতীক্ষায় ছিলাম

তোমারই আসার প্রতীক্ষায় ছিলাম,

কত জোছনা-ভেঁজা রাত

উদাস সন্ধ্যায় তোমারই প্রতীক্ষায় ছিলাম।

পথের ধারে শান্ত বৃক্ষ ছায়ায়

তোমারই অক্লান্ত প্রতীক্ষায় ছিলাম।

বিজন মন্দিরে ধ্যানস্থ ছিলাম

তোমারই মানস মুর্তির চিত্রকল্প অন্তরে এঁকে

চোখ দুটি বন্ধ করে।

উৎসুক নয়নে সম্মুখে তাকিয়ে ছিলাম,

যেখানে পথের রেখা দিগন্তে মিলিয়ে গেছে।

উৎকর্ণ হয়ে বসেছিলাম কখন তোমার পদধ্বনি

সুমধুর সংগীতের মত

এ বুকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে।

দিবসের অবসানে

তোমার অফুরন্ত রূপের আলোকে

উদ্ভাসিত করে আঁধার রজনী

চাদের মত তুমি আসবে-

আর আমি তারই অসহিষ্ণু প্রতীক্ষায় ছিলাম।

এ জীবনে এমনি কত রাত এসেছে

কত রাত চলে গেছে,

তবু এ প্রতীক্ষার আর নেই বুঝি

সুমধুর অবসান ॥

আজ তুমি নেই আমার পাশে

আজ তুমি নেই আমার পাশে

আমার জীবনে যেন ঝড় উঠেছে,

উত্তাল সাগরে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জাহাজের মত

আমি ভেসে চলেছি

জীবন সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে।

আজ তুমি নেই আমার পাশে-

আমার জীবনে চৈত্রের দাবদাহ,

আমার ফসলের প্রান্তরে

ফসলবিহীন অনাবৃষ্টি আর খরা।

আজ তুমি নেই আমার পাশে-

আমার সমস্ত আকাশ মেঘে ঢাকা

একটি ও নক্ষত্র নেই চেতনার অন্তরীক্ষে।

আজ তুমি নেই আমার পাশে-

আমি পাল-ছেঁড়া নৌকা

কান্ডারীবিহীন একটি তরণী মাঝ নদীতে-

হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে চলা ঝরাপাতা

উড়ে চলা ঠিকানাবিহীন ॥

বড় বেশি কিছু চাইনি আমি

বড় বেশী কিছু চাইনি আমি এ জীবনে,

চৈত্রের খরতপ্ত দুপুরে

এক ফোঁটা বৃষ্টির জলের স্বাদ নিতে চেয়েছি

এর বেশী কিছু চাইনি আমি এ জীবনে।

অন্ধকার অমাবস্যার রাতে

একটি জোনাকীর মত

সোনালী নক্ষত্রের মৃদু আলোর হাতছানি

শুধু চেয়েছিলাম আমি,

এর বেশি কিছু চাইনি।

বড় বেশী কিছু কখনও চাইনি আমি এ জীবনে-

তোমার বাগান হতে ডালি ভরে

ফুল নিয়ে মালা গাঁথবো

ততটা আশা কখনও করিনি আমি।

তোমার হাত থেকে

শুধু একটি লাল গোলাপ আমি চেয়েছি,

এর বেশী কিছু চাইনি।

বড় বেশী কিছু চাইনি আমি এ জীবনে ॥

এ ঘরে কেউ আসে না

এ ঘরে কেউ আসে না,

আসে কখন ও সহসা

পথ হারানো পথিক হাওয়া।

কখন ও পূর্ণিমা রাতে

ক্ষীণ জোছনার মৃদু রেখা

জানালা পথে নীরবে উকি দেয়।

এ ঘরের জমাট বিষন্ন নিস্তব্ধতা

নিঃসঙ্গ একজনকে

ঘুন পোকার মত কুরে কুরে খায়।

জ্বলন্ত মোমের মত

একজনের জীবনের অমূল্য পরমায়ু

নীরবে নিভৃতে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।

আকাশ তাকে নীল খামে চিঠি লিখে

ভালবাসা জানায়,

বাতাস তাকে চিঠি লিখে

অমৃত সুবাস ছড়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়।

ফুলের বনে সদ্য প্রস্ফুটিত সজীব পুষ্প তাকে

প্রাণঢালা অভিবাদন জানায়।

তবু সেই একজন

কিছুতেই খুঁজে পায় না সান্তনা।

অজানা বিচ্ছেদে ভরে থাকে

তার মন সারাক্ষণ।

কে যেন আসেনি বহুদিন,

কড়া নাড়েনি তার দরজায় কতদিন,

কার অসহিষ্ণু করাঘাতে

সচকিত করে তুলেনি তার নীরবতা,

কার পদধ্বনি যেন শুনা যায়নি বহুদিন... ॥

ভুলে তো যেতে চাই

ভুলে তো যেতে চাই

তুমি বলেছ ভুলে যেতে তাই,

কই পারিনা তো।

যখন দূরের আকাশে চাঁদনী রাতে

চাঁদ জেগে উঠে,

তাকিয়ে থাকি মুগ্ধ চোখে-

চাঁদের পাশে অমনি তোমার

চাঁদমুখ ভেসে উঠে বারবার।

মনে পড়ে, আহা মনে পড়ে তোমাকে

ভুলতে পারিনা তো।

যখন আপন মনে পুষ্পিত কাননে

একা একা ঘুরে বেড়াই,

ভালবাসার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে

ফুলের দিকে মুখ ফেরাই,

আর ভুলে যেতে চাই অতীতের স্মৃতিগুলোকে-

হঠাৎ যখন একটি স্নিগ্ধ কুসুমে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়,

রঙীন ফুলের পাশে তখনই

তোমার রাঙা মুখ ভাসে।

মনে পড়ে, আহা মনে পড়ে তোমাকে,

ভুলতে পারিনা তো।

যখন মন্দিরে বিগ্রহ বন্দনায় ধ্যানস্থ হই-

কখন যে দেবীমূর্তি

তোমার প্রতিমা হয়ে যায়-

আর আমি তোমাকেই পূজো দিয়ে ফিরে আসি,

মনে পড়ে, আহা মনে পড়ে তোমাকে

ভুলতে পারিনা তো ॥

তোমার জীবনে যখন অমাবস্যা

তোমার জীবনে যখন অমাবস্যা

তোমার জীবনে যখন ঘনঘোর শ্রাবণ,

আমিই ছিলাম তখন সর্বক্ষণ

তোমার ছায়াসঙ্গী হয়ে তোমারই কাছে।

যখন ঝড়ে-বাসা-ভাঙ্গা দিশেহারা পাখির মত

তুমি ছুটে বেড়িয়েছিলে-

আমি তখন আমার ছায়া বৃক্ষের শাখাতলে

তোমায় কাছে ডেকে নিয়েছিলাম।

বৈশাখের খরতপ্ত নিদাঘ দুপুরে

তোমাকে এক ঝলক হিমেল হাওয়ার পরশ

বুলিয়ে দিয়েছিলাম।

আর আজ তোমার জীবনে যখন বসন্ত,

অজস্র ফুলের সমারোহ-

তখন আমি নেই

তোমার স্মৃতিতে ও নেই, স্বপ্নে ও নেই।

তখন আমি স্মৃতির কাঁটাকুঞ্জে বসে

হারানো দিনের গান গেয়ে যাই

একা একা-

কোন এক নিঃসঙ্গ বিহঙ্গের মত ॥

যখন একটি গোলাপ দেখি

যখন একটি গোলাপ দেখি বাগানে

আপন সৌন্দর্যের মহিমায় ফুটে আছে,

তখন আমি আসলে তোমাকেই দেখি।

তুমিই তো রক্ত গোলাপ এই হৃদয়ের উদ্যানে,

তুমি সরোবরে ফোটা রাঙা পদ্ম।

যখন দেখি সুদূর আকাশে

পূর্ণিমার চাঁদ হাসে

তখন আমি আসলে তোমাকেই দেখি,

তোমার চাঁদ মুখখানা

চাঁদ হয়ে জেগে রয় দূর আকাশে।

যখন বনে উতলা বসন্তে কোকিল ডাকে

আমি আসলে তোমারই কন্ঠস্বর শুনি।

এই পৃথিবীর সব রূপমাধুরী

কোন কিছুরই তোমায় ছাড়া পূর্ণতা নেই।

তুমি আছ বলে এই পৃথিবী সুন্দর-

এই চাঁদ, এই রক্তগোলাপ

সরোবরে সদ্যফোটা রাঙা পদ্ম

সবই সুন্দর,

তোমাকে নিয়েই সুন্দর ॥

আমরা দুজন বসে আছি

আমরা দুজন বসে আছি মুখোমুখি

অনেক দিন পর দেখা,

দুজনের মাঝে দীর্ঘ নীরবতা-

বুকের ভেতর উথাল-পাতাল স্মৃতি।

তুমিও জানো সেদিনগুলো আর

ফিরে পাওয়া যাবে না কিছুতে-

আমি ও জানি।

তবু বারবার মন চলে যায় পেছনে

স্মৃতির অদৃশ্য টানে,

দুজনের মাঝে দীর্ঘ নীরবতা কথা বলে।

সময় কেড়ে নিয়েছে একে একে

দুরন্ত দস্যুর মত জীবন যৌবন-

কেড়ে নিতে পেরেছে কি ভালবাসা

আর বিশ্বাস?

স্মৃতি তো অনিঃশেষ

নদীর স্রোত কখন ও কি শেষ হয়?

চোখের সামনে যে থাকে

চলে গেলে চোখের আড়াল হয়ে যায়-

মনের মাঝে যে থাকে

সে তো কখন ও হারিয়ে যায় না ॥

চোখের আড়ালে চলে গেলে

চোখের আড়ালে চলে গেলে কি হবে

মনের চোখে আমি ঠিকই তোমায় দেখতে পাবো,

যত ছদ্মবেশে তুমি থাকো

হাজার লোকের ভীড়ে আমি ঠিকই

তোমায় খুঁজে পাবো।

যতদিন পাখি গান গাবে

নদী তরঙ্গে সুর ধ্বনিত হবে

ততদিনই তোমার কন্ঠস্বর

আমি ঠিকই শুনতে পাবো।

যতদিন বাগানে ফুল ফুটবে,

আকাশে চাঁদ উঠবে,

তোমার ফুলের মত মুখ

তোমার অই চাঁদ বদন

আমার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে না।

ঠিকানা না রেখে চলে গেলে কি হবে

যতদিন আমি বেঁচে থাকবো

আমি হাওয়ায় হাওয়ায় তোমায় চিঠি লিখবো।

আর রাত জেগে জেগে

হাজার হাজার তারার মাঝে

তোমার মুখের আদল খুঁজবো-

আর ঘুমাবো না সারারাত ॥

এই তো কিছুক্ষণ আগে

এই তো কিছুক্ষণ আগে

একজন এসেছিল এ ঘরে,

চলে গেছে খুব বেশি সময় হয়নি

একা ঘরে এখন তার আগমন-ধন্য

এক অপরূপ আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত ঘরময়।

এক অলৌকিক সুবাসে

এখনও এ ঘর যেন কেমন সুরভিত স্বপ্নময়|

ঘরে টাঙানো ছবি আর শূন্য চেয়ার,

দাঁড়িয়ে থাকা আলনা আর স্থবির টেবিল

ঘরের দেয়ালে, খোলা জানালা আর ভেজানো দরজা,

সব কিছুতে যেন নতুন প্রাণময়তা ছড়িয়ে পড়েছে।

সবাই যেন নীরব ভাষায় কলকলিয়ে উঠেছে।

একজন এসেছিল এই তো কিছুক্ষণ আগে

আমার এ ঘরে কোনরূপ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই

অপরূপ লীলাময় চলার ছন্দে,

আর আমার বিষণ্ন নির্জন ছায়াচ্ছন্ন ঘর

মুহূর্তে এক অপরূপ আলোয় উদ্ভাসিত করে দিয়ে গেছে।

একজন এসেছিল চলে ও গেছে

সমস্ত ঘর জুড়ে এখন তার স্মৃতি লেপ্টে আছে,

কুয়াশার চাদরের মত আমাকে এখনও ঘিরে রেখেছে

তার স্বপ্নঝরা লাবণ্যের সুবাতাস।

এখন ও কানে বাজছে তার ভীরু কন্ঠের

কথার কাকনের মৃদু রিনিঝিনি।

সুমধুর সঙ্গীতের মত এক অনাস্বাদিত মোহময় আনন্দে

এখন ও আমার চৈতন্য আচ্ছন্ন-

এখন আমাকে কেউ ডেকো না

এখন আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস কর না ॥

আসলে যে যাবার সে চলেই যায়

আসলে যে যাবার সে চলেই যায়-

পেছনে পড়ে থাকে ব্যথিত নির্বাক পশ্চাৎভূমি

কাজল দীঘির টলটলে জল

আকাশের দিকে বাহু-তোলা শ্যামল বৃক্ষ-

আর প্রেমিক কবির

মনের অজান্তে বেরিয়ে আসা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস।

যে যাবার সে চলেই যায়,

সমুখ পথের মোহ তাকে টানে দুর্নিবার-

অজানা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মোহ তাকে কাছে টানে

পেছনে ফিরে তাকাবার

তার আর থাকে না অবসর।

কার অশ্রুসজল ব্যাকুল দুটি চোখ

তার পশ্চাৎধাবন করে

সে খবর সে রাখে না।

পদদলিত পথের মত ভেঙে যাওয়া বুকে

তার রূপকরোজ্জ্বল স্মৃতি

আঁকড়ে পড়ে থাকে-

অবহেলিত উপেক্ষিত

যেন অনন্তকাল ধরে ॥

এখানে কেউ আসে না

এখানে কেউ আসে না

সারাদিন আর সারারাত কেটে যায়

একাকী নিঃসঙ্গতায় আর বিষণ্নতায়।

তবু জানি না কার অপেক্ষায়

সারারাত জেগে থাকি

বিনিদ্র একাকী উৎসুক নয়নে।

এখানে কেউ আসে না-

তবু জানি না কার প্রতীক্ষায় দুয়ার খুলে বসে থাকি,

সমুখ পথের দিকে চেয়ে নিষ্পলক নয়নে।

শুধু বিবাগী বাতাস মাঝে মাঝে এসে

জানালার পর্দায় দোলা দিয়ে যায়,

আর সব নিস্পন্দ নীরব।

তবু মাঝে মাঝে আশা জাগে

বুঝি এখনি কারো কলকন্ঠ

বেজে উঠবে মুখর কাকনের সুরে।

অজস্র কথামালায়

এখুনি ভরে উঠবে আমার নীরব আবাস।

জানি কেউ আসবে না,

তবু কান পেতে থাকি কার পদধ্বনির আশায়।

যে সুরধ্বনি ঝংকারে আমার শিরায় শিরায়

মুহূর্তে শিহরণ জাগবে অভূতপূর্ব আনন্দের।

এখানে কেউ আসে না,

কেউ আসবে না এখানে-

তবু কার আগমনের আশায়

কেটে যায় জীবন, জীবনের অমূল্য সময় ॥

যেমন করে বিশাল আকাশ

যেমন করে বিশাল আকাশ সারাক্ষণ

ঢেকে রাখে এ পৃথিবীকে তার পক্ষপুটে,

যেমন করে নদীর দুতীর

স্নিগ্ধ আলিঙ্গনে বুকের মধ্যে

আগলে রাখে তরঙ্গমালাকে-

প্রিয়তমা তেমনি করে

তুমি আমাকে আগলে রাখো,

তোমার ভালবাসার ছায়া অঞ্চলে।

হাজার নক্ষত্রের মত

আমার জীবনের চলার পথ

তোমার শুভদৃষ্টির আলোকে

উদ্ভাসিত করে রাখো।

আকাশ ছাড়া যেমন চাঁদ

বৃন্ত ছাড়া যেমন ফুল

অকল্পনীয়-

তেমনি তুমি ছাড়া আমার জীবন

মৃত্যুর সমান ।

তুমি ছাড়া আমার এক মুহূর্ত চলবে না,

তোমাকে আমার চোখের আড়াল হতে

আমি দেব না প্রিয়তমা....

চাঁদের মত তুমি ডুবে গেলে

আমার জীবন জুড়ে অথৈ আঁধার নেমে আসে ॥

আমার জীবনে এখন

আমার জীবনে এখন ঘোর অমানিশা

চলার পথে ধু-ধু মরুভূমি,

কণ্টকিত যাত্রাপথ-

তবু আমি চলেছি অজানা আবেশে।

আশা নেই, ভাষা নেই,

অন্তবিহীন অনন্ত রাত্রির শেষে

সৌরকরোজ্জল রাঙ্গা ভোরের প্রত্যাশা নেই-

যেন কোন এক কালবৈশাখীর ঝড়ে

সবই হারিয়ে গেছে,

সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে।

ঝঞ্ঝাক্ষুদ্ধ সাগরের ফেনিল উন্মত্ত জলোচ্ছাসে

সবই ভেসে গেছে।

মুছে গেছে তোমার রাঙ্গা পদচিহ্ন আঁকা

সাগর বেলার তটরেখা।

কেবল মুছে যায়নি এই মন থেকে

তোমার বর্ণাঢ্য স্মৃতি,

মুছবে না কোন দিনও-

সেই স্মৃতিটুকুই আমার নিরন্তর প্রেরণা

জীবন চলার পথে অমূল্য পাথেয় ॥

তুমি পাশে থাকলে

তুমি পাশে থাকলে

জীবনের অতল তলে তলিয়ে যেতে

নেই মানা,

মরনের গহন অন্ধকারে হারিয়ে

যেতেও নেই মানা।

তুমি আমার অকুল সায়রে

কুলের ঠিকানা,

তুমি আমার জীবন,

আমার প্রাণ-ভোমরা-

কাজল দীঘির অতল জলে

কৌটোয় বন্দী রূপকথার প্রাণ-ভোমরার মত।

তোমায় হারানো মানেই আমার মৃত্যু-

তোমার প্রেম আমাকে দেবে মৃত্যুহীন অমরতা

তোমার ভালবাসার ছায়ায়

আমার অমরাবতী-

তুমি আমার জীবনের

ধু-ধু মরুভূমে একটি ছায়াবৃক্ষ ॥

তবু তুমি এলে না

তবু তুমি এলে না

দীর্ঘ প্রতীক্ষায় অক্লান্ত তপস্যা শেষে

ধ্যানমগ্ন এ হৃদয়ের নিরবচ্ছিন্ন ধ্যান ভেঙ্গে

নুপুরের ঝংকার তুলে তুমি এলে না আমার জীবনে,

ঝলমল মোহমীয় বেশে

তুমি এলে না।

আমার জীবন মন্দিরে যত প্রদীপ ছিল

আমি নিভিয়ে দিয়েছি-

আমার গৃহে আলোক-জ্বালা রাত তুমি

আপন হাতে উদ্বোধন করবে বলে।

অন্ধকার পথের ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছি একা

আলোক প্রদীপ নিয়ে হাতে

জীবনের বাকী পথটুকু এগিয়ে দেবে বলে-

তবু তুমি এলে না।

আমার জীবন আজ কবির অসমাপ্ত কবিতা,

আমার জীবন আজ শিল্পীর অর্ধ সমাপ্ত ভাস্কর্য।

আমার দেহে আজ অশেষ ক্লান্তি

আমার মনে হু হু শূন্যতা।

তুমি ছাড়া জীবন তো মৃত্যুরই মত,

এই জীবনে নেই কোন উল্লাস।

জীবন তো বহতা নদী

তাকে ধরে রাখা যাবে না-

তবু তোমায় না পাওয়ার অতৃপ্ত মর্মবেদনা

চির অমর হয়ে থাকবে আমার কাব্যে

অনন্তকাল ধরে ॥

শুধু একটি রক্তিম ভোরের প্রত্যাশায়

শুধু একটি রক্তিম ভোরের প্রত্যাশায়

কত শত রাত আমি বিনিদ্র কাটিয়েছি,

একটি সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায়

কত অমানিশাকে আমি

পরম পরিহাসে বিদায় জানিয়েছি।

অথচ আমার জীবনে

রাত ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো

এলো না প্রভাত, রাঙা প্রভাত।

রাতের পরে ভোর আসে

প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে,

আমার জীবনে রাতের পর রাতই আসে

আসে না প্রভাত।

সোনা-রঙ প্রত্যুষের সোনালী প্রত্যাশায়

বারবার প্রতারিত হই-

জন্মান্ধ বুঝে না তার জীবনে

রাত আর প্রভাতে নেই কোন তফাৎ ॥

তোমাকে ভালবাসি বলেই

তোমাকে ভালবাসি বলেই

আজ আমি জগতের সবচেয়ে দুঃখী মানুষ,

আমার জীবনের বিউগলে বাজে

নিরন্তর করুণ সুর।

তোমাকে ভালবাসি বলেই

আমার জীবন সাগরে উথাল-পাথাল তরঙ্গ,

ঝঞ্ঝাক্ষুদ্ধ আমার জীবন তরী।

তোমাকে ভালবাসি বলেই

আজ আমার বুকে নিরন্তর

অনির্বাণ চিতা জ্বলে দাউ দাউ,

সর্বস্ব জ্বলে পুড়ে ছারখার।

তোমাকে ভালবাসি বলেই

না পাওয়ার বেদনায় নিঃসঙ্গতায়

হাহাকারে ভরে আছে এ মন।

তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছি অদৃশ্য দহনে।

আর আমার জীবনে

ফুল, পাখি, নদী আর নিসর্গ

অর্থহীন হয়ে গেছে ॥

তুমি চলে গেলে

তুমি চলে গেলে

আমার ভূবনে নেমে আসে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার,

যে অন্ধকারে নিজেকেই নিজে আমি

হারিয়ে ফেলি।

জনতার ভীড়ে লোকারণ্যেও

ভীড়ের মাঝখান থেকে

নিজেকে আমি আবিস্কার করি

এক জনশূন্য প্রান্তরে।

তোমার কথা থেমে গেলে

প্রস্তরীভূত প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মত

এক অনন্ত নীরবতা

আমার চারিপার্শ্ব গ্রাস করে।

আদিম গিরিগুহার মত খা খা শূন্যতা আমাকে

চতুপার্শ্ব থেকে ঘিরে ধরে।

তুমি চলে গেলে

বাগানের সব রঙীন ফুল, সবুজ পত্র-পল্লব

নিমেষে সহসা বিবর্ণ হয়ে যায়।

সহসা ছিঁড়ে যায় আমার প্রাণের বীণার তার।

আর আচমকা থেমে যায়

ঝংকৃত রাগিনীর সুর ঝংকার।

উদাসী হাওয়ায় ভেসে চলা আমার মনের খেয়া

নোঙর ছিঁড়ে কোন অজানায় নিরুদ্দেশে হারিয়ে যায়

ঠিকানাবিহীন ঠিকানায় ॥

আমাকে বাঁচিয়ে রাখে

আমাকে বাঁচিয়ে রাখে তোমার প্রেম

জীবনের অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাই,

ভেঙে পড়ি হতাশায় এই বুঝি তলিয়ে যাই,

তোমার প্রেম আমার চেতনায় সঞ্চার করে

বাঁচার প্রেরণা।

আর আমি মুহূর্তে নবজীবন লাভ করি।

আমাকে বাঁচিয়ে রাখে তোমার প্রেম,

যখন আঁধার রাতে চলার পথে

নেই কোন দিকচিহ্ন

দিকভ্রান্ত আমার সত্তা-

অকুল অন্ধকারে দিশেহারা আমি,

তখন তুমি সুদূর আকাশে

ধ্রুবতারা হয়ে আমাকে পথ দেখাও।

আমাকে পথ দেখায় তোমার প্রেম,

পথহারা আমি মরু প্রান্তরের নির্জনতায়

নিজেই যখন নিজের আর্তচিৎকারে

চমকে উঠি-

হারিয়ে গেছি বুঝি আমি!

নিমেষে মনে পড়ে তোমার মায়াবী মুখ

আর আমি বাঁচার আশ্বাস পাই,

আমাকে বাঁচিয়ে রাখে তোমার প্রেম ॥

আমি ফুলের শোভা দেখেছি

আমি ফুলের শোভা দেখেছি

চাঁদের হাসি ও দেখেছি-

দেখেছি এই চিরচেনা পৃথিবী

প্রতিদিন চোখ মেলে।

কিন্তু যেদিন তুমি বললে ভালবাসি

এই ফুল, পাখি, জোছনা

নতুন অর্থ নিয়ে ধরা দিল আমার কাছে।

সেদিন মনে হল এই পৃথিবীটা

সত্যিই সুন্দর-

আর আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে অবাক চোখে

তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলাম ॥

প্রিয়তমা যে পথে তুমি চলে গেছ

প্রিয়তমা যে পথে তুমি চলে গেছ

সেই পথপ্রান্তে আজ ও আমি

একলা দাঁড়িয়ে আছি

তোমার প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায়।

যদিও জানি এ পথে তুমি কোনদিন

ফিরবে না আর আমাকে মনে রেখে।

তোমার সামনে নতুন দিগন্ত

রাঙা সূর্যোদয় তোমায় অভ্যর্থনা জানায়,

আমার সামনে সূর্যাস্ত

অপেক্ষামান সন্ধ্যার অন্তহীন অন্ধকার।

যারা যায় তারা বুঝি এমনি করেই যায়-

যেতে যেতে দলে যায় কত পুষ্প দল।

দলে যায় হৃদয় পদতলে

ছিন্ন কুসুমের মত।

আর যে থেকে যায়

স্মৃতি শুধু তাকে আঁকড়ে ধরে

কাল ভূজঙ্গের মত ফণা বিস্তার করে

নিরন্তর দংশন করে।

নীরবে শুধু পুড়ে তার মন-

তুমি চলে গেছ প্রিয়তমা আজ বহুদিন

স্মৃতিটুকু দিয়ে উপহার ॥

একদিন জীবন মানে ছিল

একদিন জীবন মানে ছিল

একটি রাঙা প্রভাতের জন্য অপেক্ষা,

একটি রক্তিম সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা।

একদিন জীবন মানে ছিল

একটি স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা

একটি ফুল ফুটানোর জন্য অপেক্ষা।

আর আজ জীবন মানে

একটি নক্ষত্রের নিশ্চিত পতনের অপেক্ষা

আর আজ জীবন মানে

একটি প্রস্ফুটিত পুষ্পের

সকরুণ বৃন্তচ্যুতির অপেক্ষা ॥

আমি তোমার কাছেই যাই

আমি তোমার কাছেই যাই-

তুমি আমার ঠিকানা প্রিয়তমা,

আমার শেষ গন্তব্য।

তোমার চলার পথই আমার পথ।

তোমার পথের প্রতিটি ধুলিকণা

তোমারই অজান্তে তোমার পদ স্পর্শে

মুহূর্তে সোনা হয়ে যায় তুমি জান না।

সে পথের ধূলিকণা তাই আমি

মাথায় তুলে নেই।

তুমি যখন কথা বল

মনে হয় পৃথিবীর সব নদী

সুমধুর কলতানে ছুটে চলে নেচে নেচে।

সব পাখির মিলিত সংগীতে

পৃথিবী মুখরিত হয়ে যায় সুর লহরীতে।

তুমি হাসতেই মনে হয় অমনি

সব আধফোটা ফুলকলিরা

কলকল করে হেসে উঠলো।

ফুলের মত পাতার অবগুন্ঠন খুলে

তুমি যখন ঘোমটা খুলে মুখ তুলে তাকালে

মনে হয় সহসা আমার ঘরে চাঁদ নেমে এল-

জোছনায় ভরে গেলো সারা ঘরখানি ॥

ভালবাসা আমার কাছে

ভালবাসা আমার কাছে

চিরদিন থেকে গেছে

অচিন এক পাখি হয়ে -

থেকে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

ভালবাসা আমার কাছে

কখনও মনে হয়েছে

সুদূর আকাশের দূর সোনালী নক্ষত্রের মত।

ভালবাসা আমার কাছে

বহতা নদীর স্রোতধারার মত

কখন কাছে এসে সুদূরে মিলিয়ে গেছে।

আর আমি ভালবাসাহীন

নিঃসঙ্গ শূন্য জীবনের দায়ভার নিয়ে

একাকী বসে থেকেছি

জীবনের একলা ঘাটে ॥

জানি আমার ভালবাসা

জানি আমার ভালবাসা একদিন

আমার কাছেই ফিরে আসবে।

তোমরা যতই বল অস্তপাটে সূর্য ডুবলো

ঐ অন্ধকার নামলো।

এ পথের শেষ পথিকটিও চলে গেছে

কেউ আসবে না এ পথে আর।

তবুও আমি পথের প্রান্তে

দাঁড়িয়ে থাকবো অক্লান্ত প্রত্যাশায়।

জানি আমার ভালবাসা একদিন

আমার কাছেই ফিরে আসবে।

যতদিন নদী ফিরে যাবে সাগরে

যতদিন পাখি ফিরে যাবে নীড়ে

তার সাথীটির কাছে,

যতদিন ভ্রমর যাবে ফুলের কাছে,

ততদিন তার ফিরে আসা মিথ্যে হতে পারে না।

জানি আমার ভালবাসা একদিন

আমার কাছেই ফিরে আসবে।

তোমরা বলবে হয়তো এখন অন্ধকার

দারুণ অন্ধকার, গাঢ় অমাবস্যা

এই অমানিশার আঁধারে

কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

জানি অন্ধ অমাবস্যার শেষে সে যে সূর্য হয়ে হাসবে

আমার জীবন আকাশে

রাত যত গভীর হবে

তত তার প্রত্যাবর্তন নিকটবর্তী হবে -

জানি আমার ভালবাসা একদিন

আমার কাছে ফিরে আসবে ॥

আমি জীবন স্রোতে

আমি জীবন স্রোতে

নোঙরবিহীন কাগজের নৌকার মত

ভেসে চলেছি তরঙ্গে তরঙ্গে।

সকলের অলক্ষ্যে

প্রস্ফুটিত গোলাপের মত

ঝরে পড়ে আমার ব্যর্থ আশার পরে

ভোরের শিশির জমে জমে

সকালের রোদ্দুরে শুকিয়ে যায়।

আমার অশ্রুবিহীন নিঃশব্দ কান্নার

ইতিহাস নিয়ে কেউ

রচনা করে না কাব্য।

কোন মালবিকা গাথে না মালিকা।

কেউ রাখেনি খবর-

এই বুকে কিছু প্রেম ছিল

কিছু সাজানো স্বপ্ন ছিল ॥

রাত যখন গভীর হয়

রাত যখন গভীর হয়

সবার চোখে নেমে আসে

দূর থেকে উড়ে আসা পাখির ঝাঁকের মত

রাজ্যের ঘুম--

আর একটি মধুর স্বপ্নের পরশে ধন্য হয় সবাই।

আর আমার দু'চোখে তখন নামে

দুঃস্বপ্নের বন্যা --

আমার বুকে তখন জাগে উথাল-পাতাল মেঘনা।

শূন্য শয্যায় এপাশ ওপাশ করি

বৃক্ষের শাখাশ্রয়ী সাথীহারা পাখির মত

ডানা ঝাপটাই।

আমার প্রতিটি প্রহর

শ্রাবণ আকাশের মেঘের মত

দেখতে দেখতে বিশাল রূপ ধারণ করে

নিঃসঙ্গতা আমাকে জাপটে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে।

আর শুধু মনে পড়ে, তুমি নেই তুমি নেই--

আমি একা।

স্মৃতি-মধুর অতীতের কথা স্মরণ করে

ভুলতে চাই আজকের এই ব্যথিত মুহূর্তগুলো।

হৃদয়ের এই ব্যথা তবু তো লুকাতে পারি না।

অন্তর্গত অন্তর্দাহে

কেবলই ক্ষতবিক্ষত হতে থাকি

তুমিহীনতায় ॥

একদিন তুমি ছিলে

একদিন তুমি ছিলে

আমার জীবনে সবচেয়ে বড় সত্য ছিলে তুমি-

আর সবই ছিল মিথ্যা।

একদিন তুমি ছিলে আমার একান্ত কাছে।

দুনয়নের মাঝে যত ব্যবধান

তারও চেয়ে আর ও কাছে ছিলে তুমি,

আজও আছ আমার দৃষ্টির সীমানায়

প্রসারিত বাহুর সীমানায়।

তবু যেন আছো কত দূরে।

সেই মায়াভরা মুখ,

আলোঝরা দুটি চোখ,

সেই রাঙা অধরে লেপ্টে থাকা হাসি,

সবই আছে, আগের মতই আছে

শুধু তোমার মাঝে সেই তুমি নেই।

কেমন করে অচেনা মানুষ হয়ে গেলে দুদিনে!

আজ আমার জীবনে সব গান থেমে গেছে,

আজ আমার বাগানে সব ফুল ঝরে গেছে,

আজ আমার ভূবনে নেমেছে অনন্ত অন্ধকার ॥

তুমি সন্ধ্যাতারা

তুমি সন্ধ্যাতারা,

যখন সমুদ্র অন্ধকারে ডুবে যায় পৃথিবী

তুমি দূর ঊধ্ব ©গগনে

অকলংক নিষ্পলক জ্বল-জ্বল করে জ্বলো;

অনির্বাণ দীপশিখা হয়ে

জেগে থাকো আমার মনের আকাশে।

আমি আবার নতুন করে

বেঁচে থাকার আশ্বাস পাই

হতাশা-লাঞ্চিত বঞ্চনাভরা জীবনে।

ক্রমে রাত বাড়ে

সুগভীর হয় হৃদয়ে গোপন গভীর বেদনা,

চেতনা লাঞ্চিত হয়

ব্যর্থতার ক্রমপুঞ্জীভূত হতাশার দহনে।

আর একটি রক্তিম ভোরের প্রত্যাশায়

নব জীবন লাভ করে

তিলে তিলে দগ্ধ আমার অশান্ত এ আত্মা।

বিষণ্নতার শিউলি ঝরে ঝরে

জমে উঠে বিশাল পাহাড় হয়ে যায়;

সে ঝরা ফুলে জানি কেউ মালা গাথবে না।

স্মৃতির বাঁধনে বাধাঁ পড়ে থাকে

আজীবন এ জীবন ॥

তুমি আমার প্রাণ-ভোমরা

তুমি আমার প্রাণ-ভোমরা

রূপকথার কাহিনীতে যার বিবরণ মেলে।

তোমাকে হারালে বল কি থাকে আমার।

তুমি আমার হৃদয় আকাশে একটি সূর্য,

সে সূর্য নিভে গেলে নেমে আসে অন্ধকার

আমার ভূবন জুড়ে।

তোমাকে ছাড়া কি আছে আমার।

তোমার প্রতিটি কথা যেন একটি

ছন্দোবদ্ধ কবিতার পংক্তিমালা,

তোমার প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনে

আমি খুজে পাই নৃত্যের ভঙ্গিমা।

তোমার হাসির সাথে যেন

প্রতিটি ফুল হেসে উঠে বনে,

আকাশে চাঁদ হাসে।

তোমার হাসি থেমে গেলে

যেন সমস্ত বিশ্বজুড়ে

নেমে আসে বিষণ্নতা।

তুমি আমার আনন্দ,

আমার জীবনের একটি স্বপ্ন,

সেই স্বপ্ন ছাড়া জীবন আমার

দুঃস্বপ্ন হয়ে যায় ॥

শুধু তোমার জন্য ওগো বন্ধু

শুধু তোমার জন্য ওগো বন্ধু

এই গান এই সুর

এই কবিতার পংক্তিমালা

বিষণ্নতার বেদনা নিয়ে কাঁদে।

মনের আকাশে অপ্রকাশিত

পুঞ্জীভূত অভিমানের থরোথরো মেঘ।

লোকে বলে খুব বড় রকম দুঃখ

না পেলে নাকি মহৎ কবি হওয়া যায় না,

মহৎ শিল্প রচনা করা যায় না।

মহৎ কবি কিংবা শিল্পী আমি

হতে পেরেছি কিনা জানি না,

মহৎ প্রেমিক বলে নিঃসন্দেহে

পরিচিতি পেয়ে গেছি তোমার কল্যাণে ॥

শুধু তুমি থেকো

শুধু তুমি থেকো,

যদি সব নদী শুকিয়ে যায়

আকাশে এক ফোঁটা মেঘ ও হয়ে যায়

দৃষ্টি অগোচর,

চৈত্রের প্রান্তর জুড়ে যখন খরা শুধু খরা

তখন ও তুমি থেকো আমার পাশে

শুধু তুমি থেকো।

যদি দারুণ দাবানলে পুড়ে

ছারখার হয়ে যায় বন-বনান্তর,

যদি ভস্মস্তুপে পরিণত হয় বিস্তীর্ণ জনপদ-

তখন ও তুমি থেকো আমার পাশে থেকো,

শুধু তুমি থেকো।

সংগীত মুখর সন্ধ্যার সব গান

একে একে শেষ হয়ে গেলে

যখন নীরব হয়ে যাবে শ্রোতাহীন আসর,

একা আমি আর ফাঁকা চারিধার-

তখন তুমি সহসা সব স্তব্ধতা ভেঙে

আমাকে চমকে দিয়ে বল-

এই তো আমি আছি, তোমার পাশে আছি

তখন ও তুমি থেকো, আমার পাশে থেকো,

শুধু তুমি থেকো।

উৎসব শেষে একে একে যখন

আমন্ত্রিত সব অতিথি বিদায় নেবে,

শেষ অতিথি ও যখন বৃত্ত থেকে ক্রমশ বিন্দু হয়ে

দৃষ্টিসীমা থেকে অপসৃয়মান হবে-

তখন তুমি সহসা চমকে দিয়ে

পাশ থেকে বলে উঠো-

এই যে আমি থেকে গেছি,

থেকেই গেলাম,

তোমায় ছেড়ে কখনও যাব না, কোথাও যাব না ॥

শুধু তোমার মুখের একটু হাসি

শুধু তোমার মুখের একটু হাসি

দেখবো বলে

কতকাল তৃষ্ণার্ত চাতকের মত

নির্নিমেষে চেয়ে আছি।

শুধু তোমার মুখের একটি হাসি

দেখবো বলে

পৃথিবীর তাবৎ দৃশ্যপট থেকে মুখ ফিরিয়ে

তোমার মুখপানে চোখ রেখে

অপলক তাকিয়ে আছি।

তুমি হাসলে

ফুলের হাসি আর চাঁদের হাসি

সব মিথ্যে হয়ে যাবে,

তুমি হাসলে কলকলিয়ে উঠবে নদীর জল।

তুমি হাসলেই এই বিষণ্ন নিরানন্দ পৃথিবী

সহসা কলগানে মুখরিত হয়ে উঠবে।

ভোরের পাখিরা ভুল করে

ভরদুপুরে দিনের আলোতে গান ধরবে।

ভরা দ্বিপ্রহরে আকাশে চাঁদ উঠবে

মরা নদীতে জোয়ার জাগবে,

এই মৃত্যুপথযাত্রী

সহসাই ফিরে পাবে নবজীবন ॥

যদি একটি কবিতা লিখি

যদি একটি কবিতা লিখি

সে তোমার জন্যেই লিখবো,

যদি একটি গান লিখি

তোমার জন্যই লিখবো।

আমার গানের সুরলহরীতে

তোমার কথা বাঙময় হবে-

তোমারই কথা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে।

যখন তুমি ছিলে না আমার জীবনে

আমার জীবন ছিল নিস্তরঙ্গ সাগর

আমার জীবন ছিল পুষ্প-পল্লববিহীন

বিবর্ণ পাতার নিকুঞ্জ,

আমার হৃদয় ছিল শূন্যতা-ভরা।

তুমি এলে-

আমার জীবন সাগরে জোয়ার ডাকলো

তরঙ্গমুখর হল আমার সৈকত।

আমার বাগান রাতারাতি

পুষ্পশোভিত উদ্যানে পরিণত হল।

আমি যেন এতদিন ছিলাম

এক পাতালপুরীতে

প্রস্তরীভূত প্রাণহীন চৈতন্যহীন এক রাজকুমার-

তুমি সাত সাগরের অতল হতে

কৌটোয় বন্দী আমার প্রাণ ভোমরাটাকে

মুক্ত করে দিলে,

আমায় নবজীবন দিলে ॥

তোমারই প্রতীক্ষায় থাকবো

তোমারই প্রতীক্ষায় থাকবো

যখন একে একে সবাই চলে যাবে

অন্তহীন শূন্যতায় ভরে যাবে তোমার ঘর

তখনও আমি থাকবো,

তোমারই প্রতীক্ষাতে থাকবো।

যখন দিবসের শেষে

শেষ পথিকটি ও চলে যাবে

তখন ও আমি হাল ধরে

বসে থাকবো একলা ঘাটে

তোমারই প্রতীক্ষাতে।

যখন চৈত্রের দিনে দারুণ খরায়

পিপাসার্ত তোমার প্রান্তর,

আমি বর্ষার বারিধারা হয়ে

আসবো তোমার জীবনে।

তোমার বসন্ত দিনের

সাজানো বাগানের ফুল নিয়ে

মালা গাথতে আমি আসব না ;

তোমার মনের নিদাঘ দুপুরে

আমি শুধু এক ঝলক হিমেল হাওয়া

বুলিয়ে দিয়ে চলে যাবো

অজানা নিরুদ্দেশে ॥

সূর্য ডুবে গেলে নামে অন্ধকার

সূর্য ডুবে গেলে নামে অন্ধকার পৃথিবীতে,

প্রদীপ নিভে গেলে নামে অন্ধকার ঘরে

আর তুমি চলে গেলে

আমার দু'চোখে নামে অন্ধকার।

তোমাকে দিয়েই বুঝি আমি

আলো আর আঁধারের তফাৎ?

গহন অমানিশাতে

মিলনের অভিসারে যখন তুমি আসো

হাজার চোখের দৃষ্টি আড়াল করে-

মনের সব অন্ধকার দূর করে পূর্ণিমা চাঁদ উঠে আমার অন্তরে-

নিমেষে আলোকিত হয়ে যায়

আমার বিশ্বভুবন।

তুমি চলে গেলে দিবালোকিত প্রহরে ও

দু'চোখে অন্ধকার দেখি-

আমার মনের আকাশে তুমি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক

চির অনির্বাণ অম্লান ॥

***